ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১

অমর একুশে বইমেলা

ভাষা আন্দোলনের গৌরব, বইয়ের জন্য ভালোবাসা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০০:০৯, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষা আন্দোলনের গৌরব, বইয়ের জন্য ভালোবাসা

অমর একুশের গ্রন্থমেলায় পছন্দের বই দেখছেন বইপ্রেমীরা

সবে শুরু হয়েছে। বইমেলা তাই এখনো নবীন। প্রবেশ এবং প্রস্থানের মূল পথ আগেই মোটামুটি তৈরি ছিল। নিজের মতো হেঁটে বেড়িয়ে অমসৃণ পথ মসৃণ এবং ব্যবহার উপযোগী করার কাজটি পাঠকরা এখন করছেন। অবশ্য মেলায় যারা আসেন, শুরুতেই বলে রাখি, আবেগের বশবর্তী হয়ে তাদের সবাইকে পাঠক বলা বা ভাবার সুযোগ নেই। বেশিরভাগই আসলে দর্শনার্থী।

কৌতূহলী চোখে মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। সোমবার তৃতীয় দিনের মেলা ঘুরে মনে হয়েছে, আশপাশের মানুষরাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে একটি অংশ বিকেলে বা সন্ধ্যায় মেলায় ঢুকছে। অন্য বছর টিএসটি শাহবাগ পরিবাগ বা কাঁটাবন কেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডাগুলো মেলায় স্থানান্তরিত হতো।

এবার তেমনটি এখনো চোখে পড়েনি। চেনাজানা অনেক প্রিয়মুখ অনুপস্থিত। কেউ কেউ বলছেন, ধীরে ধীরে এই অপূর্ণতা দূর হয়ে যাবে। আবার কারও কারও মন্তব্য, মেলায় আসার এবং উপভোগ করার মতো পরিবেশটাও নিশ্চিত করতে হবে। 
বিগত দিনের মতো এবারও বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী  উদ্যানে বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। ভেন্যু ঠিক থাকলেও বদলে গেছে অনেক কিছু। মেলায় বিপুলসংখ্যক নতুন বই। আর চিরকালের বইগুলো তো আছেই। তারপরও মেলা ঘিরে সাধারণের যে আলোচনা সেখানে বই তেমন জায়গা পাচ্ছে না। শুরুতেই বইমেলাকে বইয়ের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো পাঠক।

দ্রুত বইয়ে ফেরার তাগিদও দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি অমর একুশে বইমেলার উৎসমূলক যে বাঙালির ভাষা আন্দোলন- সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে, মেলা অনেক হয় দেশে। বইমেলাও হয়। কিন্তু অমর একুশে বইমেলার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। সেই আলাদা জায়গাটিকে উপলব্ধি করার সুযোগ দিতে হবে।  
তাৎপর্য এবং উপলব্ধির আলোচনায় খুব প্রাসঙ্গিক ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সময়টা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গণশত্রু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই বইমেলা প্রাঙ্গণে, মানে, আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার ধ্বংস কামনা করেছিলেন। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র পরিষ্কার করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’

পরে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে একই ষড়যন্ত্রের কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন তিনি। ছাত্র-জনতা তৎক্ষণাৎ ঘৃণাভরে তার এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেছিল গোটা দেশ। নতুন মাত্রা পেয়েছিল ভাষা আন্দোলন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২। ২১ ফ্রেব্রুয়ারি রফিক, শফিক, বরকত জব্বারদের বুকে গুলি চালায় পাকিস্তানের বর্বরর বাহিনী। ছাত্রদের তাজা রক্তে লেখা হয় নতুন ইতিহাস।

প্রাণ পায় আমরি বাংলা ভাষা। এই ভাষা আন্দোলনের রক্তবীজ থেকেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান হানাদারদের বিতাড়িত করে আজকের বাংলাদেশ পাওয়া। অমর একুশে বইমেলা তাই শুধু নিছক একটি বইমেলা নয়। বাঙালির প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মারক। অমর একুশের অবিনাশী চেতনাকে ধারণ করেই অমর একুশের বইমেলার সূচনা। মেলাটি ঘিরে তাই বিপুল জন-আগ্রহ।

ভালোবাসা অপরিসীম। আর এই আবেগ ভালোবাসা বইকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, বিকাশ, সংস্কৃতির বহমান উদার অসাম্প্রদায়িক ধারায় অনন্য সংযোজন হয়ে ওঠেছে বইমেলা। মাসব্যাপী মেলায় মূলধারার প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। বইয়ের প্রদর্শনী বেচাকেনার এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন সারা বিশ্বে বিরল। বাঙালির আবেগ ভালোবাসার অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ বইমেলা তাই প্রাণের মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

শুধু বইকে কেন্দ্র করে হলেও, কালক্রমে এটি হয়ে উঠেছে বঙ্গ সংস্কৃতির বৃহৎ উৎসবে। সারা বছর বাঙালি বইটি তেমন না পড়লেও, বইমেলায় গিয়ে বই সংগ্রহ করে। অসংখ্য নতুন বই আসে মেলায়। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। প্রথম দিন থেকেই নতুন নতুন বই আসছে। 
৩২ নতুন বই ॥ তৃতীয় দিনে সোমবার একাডেমিতে জমা পড়েছে নতুন ৩২টি বই। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস গল্প কবিতাসহ নানা বিষয়-আশয়।   
মূল মঞ্চের আলোচনা ॥ বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘হায়দার আকবর খান রনো : আজীবন বিপ্লব-প্রয়াসী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সোহরাব হাসান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন, জলি তালুকদার এবং অনন্যা লাবণী পুতুল। সভাপতিত্ব করেন দীপা দত্ত।  
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। তিনি ছিলেন এদেশের বাম রাজনীতির একই সঙ্গে ছাত্র ও শিক্ষক। অগ্রজদের কাছ থেকে যে শিক্ষা নিয়েছেন সেটাই তিনি পৌঁছে দিয়েছেন অনুজ কমরেডদের কাছে। হায়দার আকবর খান রনো কখনো কট্টরপন্থার অনুসারী ছিলেন না।

তিনি ভিন্ন মেরুর বামপন্থি নেতাদের একসঙ্গে বসিয়ে আলোচনার পথ খুলে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে রনোর ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির বাইরেও বিচিত্র বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল। তিনি মার্ক্সবাদী দর্শন ও বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো অত্যন্ত সহজ ভাষায় পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন। 
লেখক বলছি মঞ্চ ॥ এই মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি চঞ্চল আশরাফ এবং শিশুসাহিত্যিক আতিক হেলাল।

×