ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১

যত্রতত্র থামানো যাবে না

গাজীপুর থেকে তিন রুটে চালু হচ্ছে কাউন্টার সার্ভিস বাস

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গাজীপুর থেকে তিন রুটে চালু হচ্ছে কাউন্টার সার্ভিস বাস

রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হচ্ছে বিশেষ বাস কোম্পানি

রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হচ্ছে বিশেষ বাস কোম্পানি। কাউন্টারভিত্তিক চলবে এ বাস। চালক ইচ্ছে করলেই পারবেন না কাউন্টারের বাইরে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাতে। প্রাথমিকভাবে আগামী বৃহস্পতিবার গাজীপুরের সাইনবোর্ড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চালু হবে এ বাস কাউন্টার।

এ রুটে থাকছে ৫০টি কাউন্টারের ১৭শ’ বাস। আপাতত প্রতিটি বাস কোম্পানির নিজস্ব ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে বাস কোম্পানিগুলো টিকিট বিক্রি করবে। পর্যায়ক্রমে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে একটি মাত্র কমন ডিভাইসের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করা হবে। 
জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। বাস মালিকরা রাজি হচ্ছিল না। তাদের বুঝিয়ে বাস্তবতার নিরিখে যাত্রীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যই এ কাউন্টার সার্ভিস চলবে। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্য রুটেও চালু করা হবে কাউন্টার সার্ভিস। গোটা রাজধানীতে এ পদ্ধতিতেই গণপরিবহনের বিশেষ চেন চালু হলে যানজট হ্রাসের পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। 
এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক জানিয়েছে, গাজীপুরের সাইনবোর্ড থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত তিন ভাগে বিভক্ত করে কাউন্টার বসানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৮টি বাস কোম্পানির এক হাজার সাতশ’ বাস-মিনিবাস চলবে এ রুটে। গাজীপুরের সাইনবোর্ড থেকে টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর ও এয়ারপোর্ট হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত এসে বাসগুলো তিনদিকে চলে যাবে। একটি রুট হচ্ছে- কুড়িল থেকে রামপুরা বাড্ডা হয়ে  সায়েদাবাদ  ও পোস্তগোলা পর্যন্ত।

দ্বিতীয় কুড়িল থেকে রামপুরা-মালিবাগ হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত। তৃতীয়টি হচ্ছে কুড়িল থেকে বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, গাবতলী হয়ে হেমায়েতপুর পর্যন্ত। সাইনবোর্ড থেকে কুড়িল পর্যন্ত এসে তিনদিকের রুটে যেভাবে যাবে, একইভাবে ফিরে আসবে বাসগুলো। এসব রুটের সব বাসই থাকবে গোলাপি রঙের, যাতে যাত্রীরা দেখেই বুঝতে পারেন এটা কোন্ রুটের।
জানা গেছে, প্রতিটি কাউন্টারেই আপাতত থাকছে কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ডিভাইস। কাউন্টার থেকে যাত্রীরা ডিভাইসে টিকিট কেটে গাড়িতে ওঠার সুযোগ পাবেন। গাড়ির ভেতরে কোনো টিকিট কাটার সুযোগ বা চেক করার সুযোগ থাকছে না। বিআরটিএ, ডিটিসি ও আরটিসির সমন্বিত উদ্যোগে কাউন্টার সার্ভিস চালুর বিষয়ে ঢাকা সড়ক সার্বিক তদারকি করছে। আগামী বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটায় আব্দুল্লাহপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন  করা হবে এই কাউন্টার সার্ভিস। 
এ বিষয়ে সাইফুল আলম জানিয়েছেন, কাউন্টার সার্ভিস চালুর বিষয়ে মালিকদের অনীহা থাকলেও তাদের এই সার্ভিসের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে জানিয়েই রাজি করানো হয়েছে। কারণ, এর আগেও একাধিকবার এ ধরনের  উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হতে হয়েছে। তবে এবার দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যাতে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হয়।

উল্লেখ্য, রাজধানীতে এর আগেও উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রিমিয়াম নামে বিলাসবহুল এসি সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। ওই সার্ভিসটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ধরে রাখা যায়নি। তারপরে একাধিকবার কিছু পরিবহন কোম্পানি গাজীপুর থেকে গুলিস্তান  পর্যন্ত কাউন্টার সার্ভিস চালু করলেও টিকে থাকতে পারেনি। এরপর সর্বশেষ রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নে কয়েক দফা প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

তারপর আবারও নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে চালু করা হয় নগর পরিবহন। মূলত ঢাকার বাসগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে ২০১৬ সালে প্রথম উদ্যোগ নেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি ঢাকার শতাধিক বাস রুট বাদ দিয়ে কেবল পাঁচটি রুটে ভাগ করে পাঁচ রঙের বাস চালানোর পরিকল্পনা হাতে নেন।

২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে সভাপতি করে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি করা হয়। সেই বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৪২টি রুটের ২২টি কোম্পানির অধীনে ৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের বাস চালানোর প্রস্তাব দেয় ডিটিসিএ। কয়েক দফা বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে সভা করার পর ২০২১ সালে তিনটি রুটে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০টি বাস নিয়ে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন।

পরে বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০টি করা হয়। কিন্তু ঢাকা নগর পরিবহনের পাশাপাশি একই রুটে অন্য কোম্পানির বাস চলতে থাকা, পরিবহন মালিকদের অসহযোগিতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তেমন সুবিধা করতে পারছিল না উদ্যোগটি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তারপরই সর্বশেষ নতুন করে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ঢাকা সড়ক মালিক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি এমএ বাতেন ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম।

তারা জানান, এবার যে কোনো মূল্যেই বাস্তবায়ন করা হবে এই কঠিন চ্যালেঞ্জ। সাইফুল আলম বলেন, বিগত ১৫ বছর সড়ক পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। ঢাকা থেকে শুরু করে সারাদেশে মালিক সমিতি, বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি, বাস টার্মিনাল এবং শ্রমিক ইউনিয়ন দখল করে চাঁদাবাজি করেছে আওয়ামী লীগের  লোকজন। তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে, দলীয় কর্মকাণ্ডে মালিক-শ্রমিকদেরও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে।

এই ধারা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা চাই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। নগরবাসী যেন স্বস্তিতে চলাচল করতে পারে এবং শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পায়, সেজন্যই নতুন সার্ভিসটির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সবার সহযোগিতা পেলে এবার সফল হওয়া যাবে।

×