বইমেলার দ্বিতীয় দিনে রবিবার পছন্দের বই দেখছেন বইপ্রেমীরা
রবিবার ছিল ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে নিবেদিত অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় দিন। সেই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে, কেমন ছিল এদিনের মেলা? উত্তরে বলতে হয়, কখনোই দ্বিতীয় দিনে সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল রূপে ধরা দেয় না বাঙালির মননের সর্বোচ্চ উৎকর্ষতার প্রতীকী প্রকাশের আয়োজনটি। তাই রবিবারও মেলার অনেক স্টলই প্রস্তুত হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মেলা প্রান্তরে পথের ধারে বালুর স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
একইভাবে বিভিন্ন জায়গায় জমেছিল ইটের স্তূপ। বাংলা একাডেমির বইমেলার বিধিমালা অনুসারে, ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিটি প্যাভিলিয়ন ও স্টলসজ্জা সম্পূর্ণ করার থাকলেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে। এদিন বিকেল অবধি প্রস্তুত হয়নি আইসিএস পাবলিকেশন। বই বিতানটির কাঠামো গড়ার কাজ চলছিল। স্টলের পাশের ফাঁকা জায়গায় সাইন বোর্ড রং করাসহ নানা কারিগরি কাজ চলছিল। শোনা যাচ্ছিল পেরেক বসানোর ঠুকঠাক শব্দ।
একইভাবে অপ্রস্তুত ছিল বেঙ্গল পাবলিকেশন, অয়ন, অদম্যসহ বেশকিছু প্রকাশনী। এবার প্রশ্ন জাগে, দ্বিতীয় দিনের বইপ্রেমী বা দর্শনার্থীদের আনাগোনা কেমন ছিল? প্রথম দিনের তুলনায় এদিন পাঠকের পদচারণা কম ছিল। কর্মদিবস হওয়ায় জনসমাগম ছিল স্বল্প। তাই বলে কি বলা যায়, এবার বইমেলা মলিন হচ্ছে? জবাবে সংশ্লিষ্টরা বলছিলেন, সব সময়েই শুরুর দিকে বইমেলার এই অগোছালো ভাবটি থেকে যায়।
ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খল অবস্থা কাটিয়ে সুন্দরের পথে ধাবিত হয়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে পাঠক, লেখক ও দর্শনার্থীদের আনাগোনায় সচল ও প্রাণবন্ত এক বই উৎসবের দেখা মেলে।
পড়ন্ত বিকেলে উদ্যানের মেলা প্রান্তরে কথা হয় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারজানা হকের সঙ্গে। আলাপচারিতায় এই গ্রন্থানুরাগী বলেন, আসলে প্রতি বছর শুরুতেই মেলার এই অগোছালো ভাবটি থাকে। তবে এসব কিছুকে খুব দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে না। কারণ, দু-একদিনের মধ্যেই এই মলিনতা ঘুচে যাবে। বরং এবার মেলার সাজসজ্জা বেশ ভালো লেগেছে। বেশ কিছু প্যাভিলিয়ন ও স্টলের বিন্যাস এবং নকশায় নান্দনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।
এ ছাড়া সদ্য প্রকাশিত কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেও ভালো লেগেছে। মূল্যও সহনীয় মনে হয়েছে। তবে এখনই বই সংগ্রহ শুরু করিনি। কয়েক দিন পর পুরোদমে নতুন বই আসা শুরু হলে শুরু হবে সংগ্রহের পালা। এর বাইরে এবার মেলাজুড়ে গণঅভ্যুত্থানের প্রতিচ্ছবিসমূহ দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আবু সাইদ, মীর মুগ্ধসহ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রাণ হারানো শিক্ষার্থীদের স্মৃতিকে চমৎকারভাবে ধারণ করেছে বইমেলা।
বিপ্লব, শোক ও আশার প্রতীক হিসেবে লাল, কালো ও সাদা রঙের মাঝে প্রস্ফুটিত তাদের ছবি এবং নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নময় স্লোগানগুলো নজর কেড়েছে। বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের আকাক্সিক্ষত আগামী দিনের নতুন সম্ভাবনার এই বাংলাদেশকেই দেখতে চায় তরুণ প্রজন্ম। নইলে পুনরায় ব্যর্থ হবে এই দেশ। বিধ্বস্ত হবে প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থানের চেতনা।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয় সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল লেখক স্বকৃত নোমানের সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে এই কথাশিল্পী বলেন, এখনো জমে ওঠেনি বইমেলা। আশা করছি, আগামী সপ্তাহ থেকে পাঠকের পদচারণায় সরবতা বিরাজ করবে মেলায়। দেখা মিলবে বইয়ের সঙ্গে পাঠকের মিতালী গড়া সুন্দরতম দৃশ্যকল্পের। তবে এবারের মেলার বড় ভয়টি হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’।
চারপাশে অনেক ধরনের মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। উচ্ছৃঙ্খল জনতার অপ্রীতিকর আচরণসর্বস্ব সেই অনাহূত ঘটনা না ঘটলে এবারের মেলা সার্থকরূপে আবির্ভূত হবে। লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের মিলনমেলার চিরচেনা চরিত্রটি অক্ষুণœ থাকবে।
এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে ৮০টি নতুন প্রকাশনা সংস্থা। এর মধ্যে ৪০টির বেশি রয়েছে ইসলামী বইয়ের প্রকাশনী। ফলে মেলার পরিসর না বাড়লেও অধিকং সংখ্যক স্টলের কারণে যখন মেলা পুরোদমে জমে উঠবে তখন চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে পাঠক ও দর্শনার্থীর চাপে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলে বলে মনে করেন প্রকাশনা সংস্থা কথা প্রকাশের ব্যবস্থা মোহাম্মদ ইউনুস।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একুশে বইমেলা হচ্ছে সৃজনশীল বইয়ের উৎসব। এ ছাড়া ইসলামী বইয়ের জন্য পৃথকভাবে বেশ কিছু বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেই বিবেচনায় এতগুলো ইসলামী বইয়ের প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দের বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নয়।
মেলা মাঠে বালুর স্তূপ, ছড়িয়ে থাকা ময়লাসহ স্টলের কাঠামো নির্মাণের অব্যস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয়ে বইমেলার সদস্য সচিব ড. সরকার আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, রবিবার আমি ও একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম মেলা পরিদর্শন করেছি। সেই বিবেচনায় বলতে পারি, মেলার ৯০ শতাংশ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি সোমবার থেকে মেলার অগোছালো ভাবটি মিলিয়ে যাবে।
পরিচ্ছন্ন রূপে দৃশ্যমান হবে একুশের বইমেলা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের ভাবনা থেকেই এবার ৪০টির মতো ইসলামী বইয়ের প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সমাজের সকল মানুষকে এক ছাতার নিচে আনার ভাবনায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এদিন প্রকাশিত হয়েছে ১৩টি নতুন বই। এগুলোর মধ্যে আগামী প্রকাশনী এনেছে ফরিদা আখতার সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ‘মহিলা মুক্তিযোদ্ধা’, নূরুল ইসলামের ইতিহাসবিষয়ক বই ‘গান্ধী-জিন্নাহর রাজনীতি : ভারত-ভাগ’ এবং আশরাফ আহমেদের সাহিত্য সমালোচনা ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম কল্পবিজ্ঞান লেখক বেগম রোকেয়া’, দি রয়েল পাবলিশার্স এনেছে শাওন আসগরের ‘নির্বাচিত কবিতা’, একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি এনেছে জোহা তালুকদারে কাব্যগ্রন্থ ‘অসমাপ্ত কাহিনীর শেষ দৃশ্য’, একই প্রকাশনী এনেছে সালমা আইনির গল্পগ্রন্থ ‘হুমুর রক্তে সবুজ পতাকা’।
একাডেমির হিসাবের বাইরে আদর্শ প্রকাশনী এনেছে আহম্মদ ফয়েজের ২৫টি শীর্ষ দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার সঙ্কলন ‘সংবাদপত্রে জুলাই অভ্যুত্থান।’
মেলামঞ্চে হেলাল হাফিজ স্মরণ ॥ অল্প লিখে গল্প বনে যাওয়া এক কবি হেলাল হাফিজ। তুমুল জনপ্রিয় প্রয়াত এই কবিকে রবিবার স্মরণ করা হয়েছে মেলামঞ্চে। এদিন মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘হেলাল হাফিজের রাজনৈতিক পাঠ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন
ড. কুদরত-ই-হুদা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মৃদুল মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন সুমন রহমান।
প্রাবন্ধিক বলেন, ঊনসত্তরের গর্ভ থেকে যেসব কবির জন্ম হয়েছিল, কবি হেলাল হাফিজ তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার উচ্চারণ ছিল রাখঢাকহীন, স্পষ্ট, অনাবিল ও অভাবিত। কবিতা তাঁর কাছে কেবল ব্যক্তিগত দীর্ঘশ^াসের বিষয় ছিল না। তিনি মনে করতেন, সমষ্টির জন্যও কবিতার একটা দায় আছে। সত্তর থেকে চুয়াত্তরের মধ্যে যে রাজনৈতিক কবিতাগুলো তিনি লিখেছেন, সেগুলোর মূল সুর কখনো মুক্তিযুদ্ধ, কখনো স্বাধীনতাত্তোর রাজনৈতিক পরিস্থিতিজাত হতাশা, আশাবাদ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের অবস্থা ও অবস্থান, রাষ্ট্রের কাছে কবির প্রত্যাশা, দ্রোহ- এসবই তাঁর কবিতায় কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে।
আলোচক বলেন, কবি হেলাল হাফিজের কবিতার কথা বললেই পাঠকের মানসপটে ভেসে ওঠে- ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ পঙ্ক্তিটি। বাংলা ভাষার যেসব কবি কবিতা, নিজস্ব জীবনদর্শন ও জীবনযাপন দিয়ে মিথ হয়ে উঠতে পেরেছেন, কবি হেলাল হাফিজ তাঁদের একজন। কবিতার ভেতর প্রেম, বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক চেতনা কবিকে মানুষের অনুভূতির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতার মাধ্যমে মানুষের অনুভূতির সেই সুরটি স্পর্শ করতে পেরেছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে সুমন রহমান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঊনসত্তর ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি সময়। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতায় সেই সময়টিকে ধারণ করেছেন। পাশাপাশি, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় উদ্ভূত দ্রোহ, সংগ্রাম, আশাবাদ, বিষাদ সব কিছুই তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন।
এদিন লেখক বলছি ॥ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি রাসেল রায়হান, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন শফিক ও শিশুসাহিত্যিক আশিক মুস্তাফা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি হাসান হাফিজ এবং জাকির আবু জাফর। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী অনন্যা লাবণী এবং শিপন হোসেন মানব। সুমন মজুমদারের পরিচালনায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সঙ্গীতমঞ্জুরী শিল্পীগোষ্ঠী’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন রিজিয়া পারভীন, প্রিয়াঙ্কা গোপ, ইসরাত জাহান, মিজান মাহমুদ রাজীব, মো. মাইদুল হক ও নাফিজা ইবনাত কবির।
আজকের মেলা ॥ আজ সোমবার বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকবে বইমেলা। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘হায়দার আকবর খান রনো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সোহরাব হাসান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন এবং জলি তালুকদার। সভাপতিত্ব করবেন দীপা দত্ত।