গণঅভ্যুত্থানেআহতরা রবিবার রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন
রবিবার বিক্ষোভ-আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে ছিল রাজধানী। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাজধানীর মহাখালীতে পঞ্চম দিনের মতো আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। সারাদিন বাঁশ দিয়ে কলেজের সামনের রাস্তা অবরোধ করে রাখেন তারা। একই দিন রাজধানীর শ্যামলী, মিরপুর ও ধানমন্ডি এলাকা স্থবির হয়ে পরে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসার দাবিতে করা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে।
শুধু তাই নয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদতে জুলাই হত্যাকা-ে জড়িতদের সেফ এক্সিট দেওয়ার প্রতিবাদ ও ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সারাদিন বিক্ষোভ করে ইনকিলাব মঞ্চ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে চাকরিচ্যুত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে হাইকোর্ট মাজার চত্বর এলাকায় দিনভর বিক্ষোভ করেন। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে এসব কর্মসূচির কারণে কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা।
কর্মজীবীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। সরেজমিন দেখা যায়, রবিবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে কর্মস্থলের উদ্দেশে মানুষ বাসা থেকে বের হলেও মহাখালী এলাকার অফিসগুলোতে যেতে বাধা পোহাতে হয়। মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট থেকে আমতলী মোড় পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে ওই রাস্তাগামী যানবাহনগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূল সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এতে সাতরাস্তা থেকে বনানী-কাকলী পর্যন্ত তীব্র যানজট তৈরি হয়। একপর্যায়ে অফিসগামীরা হেঁটে তাদের গন্তব্যে পৌঁছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত শামীম হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির কথা মাথায় রেখে ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে বের হয়েছি। কিন্তু প্রথমে পল্টন, পরে শাহবাগ এবং শেষে সাতরাস্তা পর্যন্ত দফায় দফায় যানজটে বসে থাকতে হয়। শেষে প্রায় ১২টার দিকে সাতরাস্তা থেকে হেঁটে অফিসে এসেছি।’
এদিন সকাল থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করলেও দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা মহাখালী-গুলশান সড়কের তিতুমীর কলেজের সামনে বাঁশ দিয়ে রাস্তা অবরোধ করেন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে দেখা যায়।
তবে এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ না করে চরম বিরক্তি দেখায় নগরবাসী। রফিকুজ্জামান নামের বেসরকারি চাকরিজীবী এটাকে নাটক আখ্যায়িত করে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন নাটক করছে। তাদের কারণে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তারা জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করছে না। সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন তা বোধগম্য নয়।’
এদিকে রবিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত আমরণ অনশণের কারণে চার শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েনে। তা সত্ত্বেও এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই সমর্থন দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এদিন পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই।
দাবির মুখে সরকার আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এই মুহূর্তে রাজশাহী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা উচিত। কারণ এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো কলেজ।’ এ সময় তিনি জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রাখতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ জানান তিনি। সরকারি তিতুমীর কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, তিতুমীর কলেজের অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরে যেতে চায়। তারা জনদুর্ভোগ চায় না।
সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরকে চায় না। তাই সাত কলেজকে নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি কমিটি কাজ করছে। তবে দাবি বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দেওয়া কাক্সিক্ষত নয়।
শিক্ষা উপদেষ্টার এই বক্তব্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রত্যাখ্যান করে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে আবারও হল থেকে বেরিয়ে আসেন নারী শিক্ষার্থীরা। দাবি মারা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।
তিতুমীর কলেজের আন্দোলনরত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘উপদেষ্টার আজকের বক্তব্য সম্পূর্ণ দ্বিচারিতা এবং আগের কথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে সামনে আরও কঠোর আন্দোলন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা আসবে আমরা সেই অপেক্ষায় বসে ছিলাম। আমাদের ভাইয়েরা মৃত্যু শয্যায় আছে। অনশনগত কারণে সবার অবস্থা খারাপ।
এমন অবস্থাতেও উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করছে। এর জবাব তাদের দিতে হবে।’ নাসরিন আক্তার নামের অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এর উপযুক্ত জবাব আমরা দেবো। আমরা এর চেয়ে কঠিন আন্দোলন গড়ে তুলব। তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া পর্যন্ত আমরা সড়ক ছাড়বো না।’
এদিন আমরণ অনশনের পাশাপাশি ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচির আওতায় ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তবে বিশ্ব ইজতেমা ও আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে এই কর্মসূচি কিছু সময় শিথিল ছিলো।
এদিকে জুলাই আন্দোলনে আহতদের পুনর্বাসন, ক্যাটাগরি পদ্ধতি বাতিলসহ দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে শনিবার রাত থেকেই রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত বেশ কয়েকজন। আন্দোলন চলে রবিবার দিনভর। এদিন আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবন, ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে অবস্থান নেন আহতরা। এসব এলাকা দিয়ে যানবাহন যেতে দেওয়া হয়নি।
শুধু রোগী বা অ্যাম্বুলেন্স দেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, দেখা দেয় তীব্র যানজট। ফলে ধানমন্ডি ২৭ থেকে শুরু করে গাবতলী পর্যন্ত বন্ধ থাকে যানবাহন চলাচল। এতে করে অনেক চাকরিজীবী সবময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছতে পারেননি। মিরপুর-২ এলাকার বাসিন্দা কাজল হোসেন বলেন, ‘বাংলামোটরে আমার অফিস। সকালে মোটরসাইকেলযোগে অফিসের উদ্দেশে রওনা দিলেও আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে বাসায় ফিরে আসতে হয়। একদিনের বেতন কাটা যাবে। অফিস তো আর আন্দোলনের অজুহাত শুনবে না।’
একইদিন যান চলাচল প্রায় স্থবির ছিল শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও। দুপুর থেকেই শাহবাগ মোড়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদতে জুলাই হত্যাকা-ে জড়িতদের সেফ এক্সিট দেওয়ার অভিযোগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের উদ্দেশে রওনা দেন তারা। কিন্তু হাইকোর্ট মাজার গেটে তাদের আটকে দেয় পুলিশ।
এর আগে দুপুর আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা চার দফা দাবি তুলে ধরেন। সমাবেশে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ উসমান হাদি বলেন, আইন উপদেষ্টা পোস্ট দিচ্ছেন, বিচার করতে হবে। আপনার কাছে প্রশ্ন, কারা বিচার করবে? যখন উপদেষ্টা ছিলেন না তখন বলতেন, এটা করব সেটা করব। গত ছয় মাসে কোন কাজটা করেছেন?
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী আছে, অতি দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। আমরা দেখছি বিসিএস কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করছেন। আপনারা কী করেন? ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র আরও বলেন, আমরা আর কোনো সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াব না। এখন সময় সুশীল সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। চট্টগ্রামে নেভির দাওয়াতে কীভাবে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা উপস্থিত থাকে?
ইনকিলাব মঞ্চের ৪ দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম জুলাই গণহত্যার বিচারের ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে এবং আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জুলাই হত্যাকা-ের বিচারের পরিপূর্ণ রূপরেখা সরকারকে প্রকাশ করতে হবে, সব পাবলিক প্রোগ্রামে আওয়ামী লীগের দোসরদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে, চট্টগ্রামে যেসব কর্মকর্তা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পালাতে সাহায্য করেছে এবং প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছে, অবিলম্বে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, যেসব আমলা ও সামরিক কর্মকর্তা গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে মদত দিচ্ছে, অবিলম্বে তাদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এদিকে হাইকোর্ট মাজার এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে চাকরিচ্যুত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এদিন দুপুর ১২টার পর থেকে রাজধানীর হাইকোর্ট মাজার চত্বরে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারানো পুলিশ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ফলে পল্টন, সচিবালয়, প্রেস ক্লাব এলাকায় তৈরি হয় তীব্র যানজট।
বেসরকারি অফিসের কর্মী নুসরাত জাহান বলেন, এসব আন্দোলন কবে শেষ হবে জানি না। প্রতিদিন মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে অফিসে আসতে কি যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। রাস্তায় যানজটের কারণে মেট্রোরেলেও যাত্রীর চাপ বেশি হয়। ফলে সেখানেও ভোগান্তি পোহাতে হয়।