ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ মাঘ ১৪৩১

লাখো মুসল্লির ‘আমিন আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত তুরাগ তীর

মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা

টঙ্গীতে রবিবার বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা

টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কণ্ঠে আমিন আল্লাহুমা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রবিবার শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ। মোনাজাতে মহান আল্লার কাছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার তৌফিক কামনা করা হয়।

জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ্ ভিক্ষা করছিলেন মুসল্লিরা। ক্ষমা লাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তারা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনা করা হয় তবলিগ জামাতের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের আখেরি মোনাজাতে। এর আগে হেদায়েতি বয়ান করা হয়।

ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত চলাকালে পৃথক দুটি ড্রোন দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে দিগি¦দিক  ছোটাছুটি করতে গিয়ে প্রায় একশ’ জন মুসল্লি আহত হয়েছেন। 
এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব দু’টি ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সোমবার হতে শুরু হচ্ছে এ পর্বের দ্বিতীয় ধাপ। বিশ্ব তবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের অনুসারী শূরায়ে নেজামের নেতৃত্বে এ পর্বটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দু’টি ভাগে বিভক্ত এ পর্বের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হচ্ছে সোমবার হতে।

এ ধাপের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছেন শূরায়ে নেজামের মুসল্লিরা। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তবলিগ অনুসারীরা এ পর্বের ইজতেমায় অংশ নেবেন। তিনদিনব্যাপী এ পর্বের ইজতেমা আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। 
মোনাজাত ॥ এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের শেষদিন রবিবার বিশ্ব তবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের তবলিগ মারকাজের কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের ছোট ছোট বাক্যে আরবি-উর্দু ও বাংলা ভাষায় প্রায় ২৭ মিনিটব্যাপী আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন। তিনি সকাল ৯টা ১০মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু করেন এবং তা চলে ৯টা ৩৭ মিনিট পর্যন্ত।

পবিত্র কুরআনের আরবি আয়াত এবং বাংলা ও উর্দু ভাষায় প্রায় ২৭ মিনিট ব্যাপী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোনাজাত শুরু হতেই পুরো এলাকা জুড়ে নেমে আসে পিন পতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। খানিক পর পর শুধু ভেসে আসে আমিন, ছুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন। অনুতপ্ত মানুষের কান্নার আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তারা। ক্ষমা লাভের আশায় ধনী-গরিব-শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষে সর্বস্তরের লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তারা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে তবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে রবিবার।

এবারের প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২৫-৩০ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা। মুঠোফোন ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের আরও লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। অনেকে রাজধানীর বিমানবন্দর গোল চত্বর কিংবা উত্তরা এবং গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
মুসল্লিদের বাঁধভাঙা জোয়ার ॥ এদিকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার ভোর রাত থেকেই টঙ্গীর ইজতেমা অভিমুখে শুরু হয় বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মানুষের ঢল। টঙ্গীর পথে শনিবার মধ্যরাত থেকেই ইজতেমা ময়দানগামী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোটর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মোনাজাতে অংশ নিতে শীত ও নানা ঝামেলা উপেক্ষা করে চারদিক থেকে লাখ লাখ মুসল্লি পায়ে হেঁটেই ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন।

মোনাজাতের আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ায় মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ আর মানুষ।

ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৪-৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রবিবার আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠানে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার সকালেই টঙ্গীর ইজতেমা এলাকায় পৌঁছেন। 
শেষ দিনে বয়ানকারী ॥ বিশ^ ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লা রায়হান জানান, রবিবার বিশ্ব তবলিগ জামাতের প্রথম পর্বের শেষদিন ফজরের নামাজের পর হতে হেদায়েতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান। তিনি তবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে যারা তবলিগের সফরে আল্লাহর রাস্তায় জামাতে বের হবেন সেইসব মুসল্লির উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনামূলক হেদায়েতি বয়ান করেন। তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন।

এরপর আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত নসিহতমূলক কথা বলেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তার বক্তব্যের তরজমা করেন মাওলানা জুবায়ের। এ সময় ইজতেমাস্থলে আগতরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেসব বয়ান  শোনেন। তবে এদিন হেদায়েতি বয়ানের আগে আর কোনো বয়ান হয়নি।
মোনাজাতে যা বলা হয় ॥ মাওলানা জুবায়ের মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ তুমি তো ক্ষমাশীল, তোমার কাছেই তো আমরা ক্ষমা চাইব। দ্বীনের ওপর আমাদের চলা সহজ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তৌফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত কর। নবীওয়ালা জিন্দেগি আমাদের নসিব কর।

হে আল্লাহ আমাদের ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দাও। গোপন গুনাহ, প্রকাশ্য গুনাহ সব গুনাহ মাফ করে দাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত কর। এ বিশাল ময়দানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যার হাতকে আপনার পছন্দ হয় তার উছিলায় আমাদের সবার মোনাজাত কবুল করে নেন।

আমাদের জিন্দেগি গুনাহমুক্ত হওয়ার তৌফিক দেন। দুুনিয়ার সব নর-নারীর জীবনের গুনাহ মাফ করে দেন। হে আল্লাহ ইমানের হাকিকতে তামাম নসিব করে দেন। হে আল্লাহ ইমানি সিফাত আমাদের মধ্যে পয়দা করে দেন। হে আল্লাহ আমাদের ইমানি জিন্দেগি নসিব করে দেন। হে আল্লাহ আমাদের ইমানকে শক্তিশালী করে দেন। 
দুটি ড্রোন দুর্ঘটনা, মুসল্লি আহত ॥ টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত চলাকালে পৃথক দুটি ড্রোন দুর্ঘটনার শব্দ আতঙ্কিত হয়ে মুসল্লিদের দিগি¦দিক  ছোটাছুটিতে পদদলিত হয়ে, ড্রেন ও রাস্তায় পড়ে প্রায় একশ’ মুসল্লি আহত হয়েছেন। মোনাজাত শেষ হওয়ার ১০/১২ মিনিট আগে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এ ঘটনা ঘটে।
মোনাজাতের সময় আকাশে ওড়ার সময় একটি ড্রোন হঠাৎ ইজতেমা ময়দানের বিদেশী কামরার টিনের চালার ওপর আছড়ে পড়ে। টিনের ওপর আছড়ে পড়ায় বিকট শব্দ হলে আতঙ্কিত হলে মোনাজাত ফেলে মুসল্লিরা মাঠ ছেড়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে দৌড়াতে থাকেন। এ সময় অনেকেই বলতে থাকে সা’দপন্থিরা হামলা চালিয়েছে সবাই পালাও।

মুসল্লিদের এমন দৌড়াদৌড়ি ইজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে উত্তরে চেরাগআলী, দক্ষিণে টঙ্গী আবদুল্লাহপুর, পূর্বে টঙ্গী স্টেশন, পশ্চিমে কামারপাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকে পদদলিত হন। এতে অর্ধশতাধিক মুসল্লি আহত হন। মোনাজাতের পর ইজতেমার বয়ান মঞ্চ থেকে মুসল্লিদের আশ্বস্ত করে ঘোষণা করা হয় একটি ক্যামেরা ড্রোন ইজতেমা ময়দানের একটি টিনের ছাউনিতে আছড়ে পড়েছিল, এতে ভয় বা আতঙ্কের কোন কারণ নেই। আমরা সবাই খামোস থাকি। 
অপর ঘটনাটি ঘটে টঙ্গী হাসপাতালের সামনে। এ ড্রোনটি আকাশে ওড়ার সময় হঠাৎ নিচে একটি দোকানের বেলুনের ওপর আছড়ে পড়ে। ড্রোনটি গ্যাসের খেলনা বেলুনের ওপড় আছড়ে পড়লে বিক্রেতার বেলুনগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এতে চতুর্দিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মোনাজাতরত মুসল্লিরা আতঙ্কিত হয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের জন্য দিগি¦দিক  ছোটাছুটি শুরু করেন। এতে প্রায় অর্ধশত মুসল্লি আহত হন। 
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ছবি সংগ্রহের জন্য ক্যামেরা সংবলিত ড্রোন দু’টি আকাশে উড়ছিল। এসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বা চার্জ শেষ হয়ে ড্রোনগুলোর একটি ইজতেমা ময়দানের টিনের ছাউনিতে এবং অপরটি টঙ্গী মেডিক্যালের সামনের সড়কে গ্যাস বেলুন বিক্রেতার বেলুনের ওপর আছড়ে পড়ে শব্দের সৃষ্টি হয়। হঠাৎ এ ঘটনা ঘটায় মুসল্লিরা আতঙ্কিত হয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। 
গরম পানিতে ঝলসে গেলেন ৪ মুসল্লি ॥ বিশ্ব ইজতেমায় গরম পানিতে ঝলসে গুরুতর আহত হয়েছেন চারজন মুসল্লি। রবিবার আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর ময়দান থেকে হুড়াহুড়ি করে বের হওয়ার সময় চা’য়ের কেটলির গরম পানি পড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। 
আহত মুসল্লিরা হলেন- বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার অলিদা বাগান গ্রামের আমজাদ সরকারের ছেলে জুয়েল (২৫), নাটোরের ফজলুর রহমানের ছেলে সোহেল (৩০), ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার জাবেদ আলীর ছেলে ফজল হক (৩৪), জামালপুরের আব্বাস আলী সরকারের ছেলে মোজাফফর আলী সরকার (৪৪)। তাদের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ফরিদ হোসেন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আখেরি মোনাজাতের পর হুড়াহুড়ি করে মুসল্লিরা ময়দান থেকে বের হওয়ার সময় অসাবধানতাবশত ইজতেমার ৪ নং গেটের ভেতরে চা’য়ের কেটলির গরম পানি পড়ে যায়। এ সময় পানি ছিটকে চার মুসল্লি আহত হয়। তাদের মধ্যে মুসল্লি জুয়েলের ডান পায়ে চা’য়ের কেটলি পড়ে হাঁটুর নিচের অংশ ঝলসে যায়। তাকে উদ্ধার করে টঙ্গীর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাকিল বিন সিরাজ জানান, গুরুতর আহত জুয়েলকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলের বার্ন ইউনিটে রেফার্ড করা হয়েছে।
মোনাজাত শেষে বিস্ময়কর মানবজট ॥ মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া লক্ষাধিক মানুষ ভিড় ঠেলে একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। এতে ইজতেমা ময়দান এলাকার কামারপাড়া রোডে সৃষ্টি হয় বিস্ময়কর দীর্ঘ মানবজট। ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা হতে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হওয়া লাখ লাখ মুসল্লির প্রচ- ভিড়ের কারণে ইজতেমা ময়দান এলাকার কামারপাড়া সড়কের দু’পাশের সংযোগ মোড়ে মানব ও যানজটের সৃষ্টি হয়।

বিস্ময়কর এ মানবজটে আটকা পড়ে মুসল্লিদের ভিড়ের মাঝে দীর্ঘ সময় একইস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মানবজট ছাড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। এ সময় অনেকের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন মালামাল খোয়া যায় এবং কয়েকজন আহত হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য সেখানে পৌঁছে দীর্ঘ সময় চেষ্টার পর মানবজট ছাড়াতে সামর্থ্য হন। মোনাজাত শেষে গণপরিবহন না পেয়ে অনেক মুসল্লি ইজতেমা মাঠ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে হেঁটে রওনা হন। 
আরও ২ মুসল্লির মৃত্যু ॥ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লা রায়হান জানান, ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপে আগত আরও দুই মুসল্লি শনিবার দিবাগত রাত হতে রবিবার আখেরি মোনাজাত শুরুর আগ পর্যন্ত মারা গেছেন। তারা হলেন- হবিগঞ্জ জেলা সদরের রামনগর তেগরিয়া এলাকার মৃত দোস্ত মোহাম্মদের ছেলে রমিজ আলী (৬০) ও ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানা এলাকার হাজী আব্দুল গফুর (৭৫)। এ নিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপে যোগ দিতে আসা ৫ মুসল্লি হৃদরোগ, ঠান্ডা ও বার্ধক্যজনিত কারণে ইজতেমা ময়দানে মারা গেছেন। 
টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ॥ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর ও টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ছিল। ফলে এবার এসব কারখানার শ্রমিকদের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে সমস্যা হয়নি। 
টেলিভিশন-মুঠোফোন ও ওয়্যারলেস সেটে মোনাজাত ॥ ইজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। টঙ্গীর ইজতেমাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে গত কয়েকবারের মতো এবারও গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদের মাইকে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করা হয়। এখানে কয়েক হাজার নারী পুরুষ ঈদগাহ মাঠে এবং পার্শ্ববর্তী সড়কে ও ভবনগুলোতে জড়ো হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন।

এছাড়াও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় টেলিভিশন, ওয়্যালেস সেট ও মুঠোফোনের মাধ্যমে মোনাজাত প্রচার করা হয়। এ সব স্থানেও পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করার কারণে অনেকে বাসায় বসে মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। এ ছাড়াও দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকে ইজতেমাস্থলে অবস্থানকারীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেও মোনাজাতে শরিক হয়েছেন। 
প্রথম পর্বে দু’সহ¯্রাধিক জামাত তৈরি ॥ বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে তবলিগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমাস্থলে প্রথম পর্বে দু’সহ¯্রাধিক জামাত তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে দেশীয় জামাত হয়েছে প্রায় দু’হাজার এবং প্রায় ৮শ’ বিদেশী জামাত হয়েছে। এসব জামাতে কেউ কেউ এক চিল্লা, দু’চিল্লা, তিন চিল্লা, ছয় চিল্লা ও একবছরের চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামী ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
বিদেশী মুসল্লি ॥ রবিবার দুপুর পর্যন্ত  বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চাঁদ, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, মালয়েশিয়া, মরক্কো, নেপাল, কেনিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্দান ও দুবাইসহ বিশে^র ৭৬টি দেশের প্রায় ৩ হাজার ৫০ জন মুসল্লি অংশ নেন। তাছাড়া এ পর্বে দেশের ৬৪টি জেলার কয়েক লাখ মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন বলে ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লা রায়হান জানিয়েছেন। 
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ॥ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বিপুলসংখ্যক নারী। ইজতেমায় নারীদের অংশ নেওয়ার বিধান না থাকলেও এসব নারীর অধিকাংশই আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেন।

এ ছাড়াও ভোর থেকে নারীরা ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের মাঠ, ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ও আশপাশের খোলা ময়দানে অবস্থান নেন। তারা স্ব স্ব অবস্থানে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
ইজতেমায় ড্রোন ওড়ানোতে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা ॥ রবিবার আখেরি মোনাজাত চলাকালে পৃথক দুটি ক্যামেরা ড্রোন দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে দৌড়াদৌড়িতে শতাধিক মুসল্লি আহত হওয়ায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ডক্টর মোহাম্মদ নাজমুল করিম খান ইজতেমা মাঠের চতুর্দিকে ২ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী যে কোনো ধরনের ড্রোন ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রবিবার রাতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন।
গণবিজ্ঞপ্তিতে ইজতেমা মাঠে ড্রোন দুর্ঘটনায় আহতের ঘটনা উল্লেখ করা না হলেও এই ঘটনায় এমন ড্রোন নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত বলে পুলিশের সূত্র বলছে। গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ শাখার (সিটিএসবি) অনুমতি ব্যতীত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ড্রোন ও ড্রোন ক্যামেরা অথবা ভিডিওসহ অন্য কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস উড়ানো বা ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

×