ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে শনিবার বেলুন উড়িয়ে জাতীয় কবিতা উৎসব উদ্বোধন করেন অতিথিরা
কবিতাই বলে মানবতার কথা। কবিতাই খুঁজে নেয় প্রগতির পথরেখা। কবিতাই বলে যায় প্রগতিবিরোধী ভূলুণ্ঠিত মানবতার কথা। কবিতার আশ্রয়েই কবিরা লড়ে যান অমানবিকতার বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে মানুষ যখন লোভী ও স্বার্থান্ধ হয়ে ওঠে তখন কাব্যবীজের স্ফুরণে জেগে ওঠেন আলোর পথযাত্রীরা। এভাবে সত্য ও সত্তাকে প্রকাশ করে কবির সৃষ্ট কবিতা।
শব্দের পিঠে শব্দের সংযোজনে উচ্চারিত হয় তার অন্তর্নিহিত বিষয়। সে শব্দমালায় থাকে দ্রোহ, প্রেম কিংবা সময়ের দিনলিপি। সেই সুবাদে সামাজিক অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে সাম্য ও সম্প্রীতির বারতায় শুরু হলো ৩৭তম জাতীয় কবিতা উৎসব। শনিবার সকাল প্রাণের স্পন্দন বয়ে যায় উৎসব আঙিনা ঢাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে। সারাদেশের নানান প্রান্তের কবিরা দিনভর পাঠ করেছেন স্বরচিত কবিতা।
আর কবিতার সেই শিল্পিত উচ্চারণে উঠে এসেছে দ্রোহের কথা, শান্তির প্রত্যাশা, অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনের কথা, শাশ্বত ভালোবাসার বাণীসহ বিবিধ বিষয়। সকাল থেকে রাত অবধি নানা অধিবেশনে উচ্চারিত হয়েছে কবিতার পঙক্তিমালা। জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এবারের উৎসবের প্রতিপাদ্য ‘স্বাধীনতা সাম্য ও সম্প্রীতির জন্য কবিতা’।
শীতল সকালে উৎসব চত্বর থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছায়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও পটুয়া কামরুল হাসানের সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। এর পর জাতীয় পতাকা ও কবিতা পরিষদের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে উৎসবের উদ্বোধন করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাইদের মা মনোয়ারা বেগম ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরায়ার ফারুকী।
এর পর উড়িয়ে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বর্ণিল বেলুন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শহীদ নাফিসের বাবা গালাম রহমান, কবিতা পরিষদের আহ্বায়ক কবি মোহন রায়হান, সদস্য সচিব রেজাউদ্দিন স্ট্যালিনসহ কবিতা পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও কবিরা।
উৎসব উদ্বোধনের পর মঞ্চে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। এ সময় একুশের গান, উৎসব সংগীত ও জুলাইয়ের গান পরিবেশন করেন সংগীত শিল্পীরা। দুদিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনে দিনব্যাপী পাঁচটি পর্বে কবিতা পাঠ করেছেন আমন্ত্রিত দেশী-বিদেশী কবিবৃন্দ ও নিবন্ধিত কবিবৃন্দ। এবারের উৎসবে দেশের কবিদের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন ইরান, জাপান ও ফিলিস্তিনের কবিরা। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আবৃত্তি পর্ব ও কবিতার গান পর্বের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের উৎসব শেষ হয়।
শনিবার পর্যন্ত উৎববে কবিতাপাঠের জন্য নিবন্ধন করেছেন সারাদেশের ৪৫৯ জন কবি। নিবন্ধিত কবিদের স্বরচিত কবিতা ও আমন্ত্রিত কবিদের কবিতা পাঠ, দেশের খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী আবৃত্তি, গান, নৃত্য, সেমিনারে সজ্জিত হয়েছে এবারের উৎসব।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরায়ার ফারুকী বলেন, আমি একজন ব্যর্থ কবি। ব্যর্থ কবি এই অর্থে যে আমি শুধুই গোপনে কবিতা লিখেছি কিন্তু ছাপানোর সাহস কোনোদিন হয়নি। পরে ইদানীং মনে হয় দুই একটা কেউ কেউ চেয়ে নিয়ে ছেপেছে। কবিতা লিখতে অনেক সাহস লাগে। আমার নিজেকে খুব লাজুক মানুষ মনে হয়। আপনি ভাবতে পারেন যে লাজুক মানুষ এতগুলো মানুষের সামনে কিভাবে কথা বলছে? এটা হচ্ছে ভাগ্যের ফের।
কবিতা কবি যখন লিখে এমনকি যদি একটা ক্যাফেতে বসেও লিখে ওনি কিন্তু একটা নির্জনতার মধ্যেই লেখেন। কবিতা লিখবার প্রক্রিয়াটা খুবই নির্জন এবং কবিতা যখন পাঠক পড়ে তখন তিনি একটা নির্জন প্রক্রিয়ার মধ্যে হারিয়ে যান। হয়তো মধুর ক্যান্টিনে বসে কবিতা পড়ছে কিন্তু চলে গেছে হয়তো প্রেয়সীর সঙ্গে কোন এক বাগানে। সো কবিতা খুবই ট্রান্সফরমেটিভ একটা জিনিস। আপনাকে আরেকটা জগতে ট্রান্সলেট করে।
কিন্তু পাশাপাশি কবিতা যখন সময়ের প্রয়োজন আসে সময়ের ডাক আসে তখন কবিকে আসলে মানুষের পক্ষে অবস্থান নিতে হয়। এই যেমন আমি হাসান রোবায়েত একটা নাম মনে এলো। আরও কবি লিখেছেন। রওশন আরা গুপ্ত একটা কবিতা লিখেছেন যে মেট্রোরেল দেখে কান্না পায়। সেরকম আরও অনেকেই লিখেছেন। কবিতা খুব ব্যক্তিগত জিনিস। কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর যখন জনগণের ওপর যখন খড়গ এবং বুলেট এসে পড়ে তখন কবির দায়িত্ব হয় জনগণের পক্ষ নেয়া।
আর কবি যদি সে পক্ষ না নেন তাহলে আমরা মনে করি কবি শিল্পী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেনি। দুর্ভাগ্যবশত গত ১৫-১৬ বছর ধরে আমাদের বেশিরভাগ কবি সেই দায়িত্ব পালন করেননি। আমি বিশ্বাস করতে চাই আমাদের শিল্প সাহিত্য অঙ্গনের মানুষ সবাই জনগণের পক্ষেই থাকবেন এবং যেটা জনগণের ভালো সেটার পক্ষে কথা বলবেন এতে যার সমালোচনা হয় যার বিরুদ্ধে যায় সেটার দিকে শিল্পী বা কবিদের তাকানো উচিত না এবং সরকারের বিরুদ্ধে গেলেও গো এহেড আপনারা বলতে থাকেন।
সে কারণে আজকে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক শহীদ আবু সাইদের মা। এই উদ্বোধক নির্বাচনটাই বলে দেয় আমরা কোন বাংলাদেশে আছি এবং কোন পথে হাঁটছি। আপনি দেখবেন যে এবারের আন্দোলনে কবি নজরুল নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়েছেন। তার কবিতা বিভিন্ন জায়গায় দেওয়ালে লেখা হয়েছে, গানে এসেছে, স্লোগানে এসেছে। এবারের আন্দোলনে কবিতা, গ্রাফিতি, এগুলো কার্যকরভাবে মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। অর্থাৎ, আমরা শিল্পের শক্তির কাছে আবারও ফিরে গেছি।
আজ রবিবার সকাল দশটায় তারুণ্যের গান পর্বের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ও শেষ দিনের উৎসব শুরু হবে। এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনটি পর্বে নিবন্ধিত কবিরা কবিতা পাঠ পর্বে। দ্বিতীয় দিনে বিকেল চারটায় বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে ‘স্বাধীনতা সাম্য ও সম্প্রীতি : বাংলাদেশের কবিতা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে মূল আলোচনা করবেন গবেষক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।
বিকেল পাঁচটায় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমন্ত্রিত কবিরা কবিতাপাঠ করবেন। আমন্ত্রিত আবৃত্তিশিল্পীবৃন্দকে নিয়ে রাত সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত আবৃত্তি পর্ব ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের অংশগ্রহণে নৃত্যপর্ব অনুষ্ঠিত হবে। রাত নয়টায় সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে ৩৭তম জাতীয় কবিতা উৎসবের।