রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কারো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কারো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি গত ৮ বছরেও। টুকরো টুুকরো ভাড়া বাড়ি ও ধার করা কলেজ ক্যাম্পাসে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও ক্লাসরুমের কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠার ৮ বছরেও নিজস্ব ক্যাম্পাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন তো দূরের কথা একটি ইটও গাঁথা হয়নি। বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন।
সপ্তাহব্যাপী সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু পাঠদানের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। কিশ্বকিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক প্রত্যেকেই আশাহত। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপন প্রকল্পের প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে একনেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়টি চূড়ান্ত ফয়সালা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কলকাতা থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনে বিশ্বকবির প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপ্রেরণায় সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৬০ কিমি দূরে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরে এই বিশ^বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। বুক ভরা আশা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, ভিসিসহ শিক্ষকরা নতুন উদ্যোমে শিক্ষিত জাতি গঠনে কাজে যোগ দিয়েছেন।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাইবুর রহমান বলেন, অনেক আশা নিয়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বাস্তবে কিছুই পাচ্ছি না! লাইব্রেরি, আবাসন ও শিক্ষার মুক্ত চর্চার সুযোগ মিলছে না। নিজস্ব অর্থ খরচ করে মেসে ভাড়া থেকে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক বটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আয়েশা ইয়াসমিন বলেন, অনেক কিছুই শুনে ভর্তি হয়েছিলাম। এসে দেখি ৩টা ভবন, তাও ভাড়া করা। একটা লাইব্রেরি থাকলেও দূরত্ব অনেক বেশি। ২০ টাকা করে ৪০ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতে হয়। ভাড়া বাসায় থেকে নিজেদের টাকায় রান্না করে খেতে হয়।
সংগীত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের অপর ছাত্র আবদুল মমিন বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধরনের শিক্ষার সুযোগ থাকা দরকার, তার কিছুই নেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুঁথিগত পড়াশোনা হলেও ব্যবহারিক শিক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষের সংকট তো রয়েছেই। এভাবেই তিন বছর পেরিয়ে গেল।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সামিয়া আকতার জানান, আমাদের আবাসন সংকট চরমে। বাইরে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে। এভাবে থাকাটা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো নিরাপত্তা ছাড়া রাতে আমাদের লাইব্রেরিতে পড়তে যেতে হয়। এতে বখাটেদের দ্বারা নানান রকম ইভটিজিং ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অথচ স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকলে এসব সমস্যা হতো না। তবে আমাদের এই দাবি সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করছে না। এবার দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানান।
স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করলেও প্রায় ৮ বছর পরে গত ২৯ জানুয়ারি বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিপি অনুমোদন হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে একনেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়টি চূড়ান্ত ফয়সালা না আসলে সচিবালয় ঘেরাওসহ কঠোর লাগাতার আন্দোলনে যাবার আল্টিমেটাম দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। পরে ২০১৮ সালের এপ্রিলে শাহজাদপুর মহিলা কলেজে অস্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু হয়। এভাবে আট বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন হয়নি।
বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে বসে সৃষ্টি করেছেন তার অসংখ্য কালজয়ী রচনা । প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী,প-িত,গবেষক ও বিদ্যার্থী আসেন বিশ্বকবির বাসভবন পরিদর্শনে। অথচ বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মিত না হওয়ায় দর্শনার্থী, প-িত, গবেষক ও বিদ্যার্থীরা হতাশ হয়ে ফিরে যান।
সরেজমিনে দেখা যায়, শাহজাদপুর মহিলা কলেজটির চারতলা একটি ভবনের তিন তলা ব্যবহার করছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। এই ভবনের তিনতলায় ছোট্ট একটি কক্ষে কয়েকটি চেয়ার-টেবিল রাখা। সেখানে বসেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি, সংগীত ও বাংলা বিভাগের ২০ শিক্ষক। দেখেই বোঝা যায়, কক্ষটিতে কোনোমতে বসা গেলেও এখানে বসে পাঠদানের প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে এখন সাত ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করছেন। সংগীত ও বাংলা বিভাগ তো রয়েছেই। কিন্তু এসব বিভাগের ক্লাসের জন্য শ্রেণিকক্ষ মাত্র একটি। তাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন শিক্ষকরা। নেই কোনো সেমিনার কক্ষ।
অন্যদিকে সরকারি বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজের নিচতলার একটি কক্ষে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। এর আকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরির সমান। আবার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন এই গ্রন্থাগার থেকে অনেকটা দূরে।
সেখানে গিয়ে জানা গেল দুটি ভবনে ভাড়া করে চলছে প্রশাসনিক কাজ। সেখান থেকে অনেকটা দূরে ‘সীমান্ত কনভেনশন সেন্টার’ ভাড়া নিয়ে সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং মিলনায়তনের কার্যক্রম চালু করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। পার্শ্ববর্তী মওলানা ছাইফউদ্দিন এহিয়া ডিগ্রি কলেজের একাংশে চলে ব্যবস্থাপনা বিভাগের পাঠদান।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে এখন সাতটি ব্যাচে শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করছেন। সংগীত ও বাংলা বিভাগ তো রয়েছেই। কিন্তু এসব বিভাগের ক্লাসের জন্য শ্রেণিকক্ষ মাত্র একটি। তাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন শিক্ষকরা। নেই কোনো সেমিনার কক্ষ।
এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আট বছর ধরে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চলছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। এদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আবাসিক হল না থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের বাসাভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে। এতেও তাদের বাড়ছে খরচ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি অনুষদের অধীনে ৫টি বিভাগ চালু রয়েছে। এতে এক হাজার দুইশ’র বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে শাহজাদপুর মহিলা কলেজ, সরকারি বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও মওলানা ছাইফউদ্দিন এহিয়া ডিগ্রি কলেজের শ্রেণিকক্ষে এবং দুটি ভবন ও একটি কনভেনশন সেন্টারের জায়গা ভাড়া নিয়ে।
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার শাহজাদপুর মহিলা কলেজ কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে কলেজের কক্ষ ছেড়ে দেওয়ার জন্য একাধিকবার চিঠিও দিয়েছে। তবে তারা নিরুপায় হয়ে কোনো উত্তর দেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ স্থাপন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) করা হয়েছিল ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এরপর এটি পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রথমে সংশোধিত প্রস্তাবনা করা হয় ২ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এভাবে সাতবার বাজেট সংশোধিত প্রস্তাবনার পর অষ্টমবার ৫৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা সংশোধিত ডিপিপি প্রস্তাবনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের মেয়াদের সময় হবে ১ মার্চ ২০২৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৯ সাল পর্যন্ত। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়ার সই করা একটি পত্রের মাধ্যমে এটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিপি অনুমোদন হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে একনেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়টি চূড়ান্ত ফয়সালা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২২৫ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ একর জমির ওপর যখনতখন ক্যাম্পাস নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত আট বছরে একটি ইটের টাকাও বরাদ্দ মেলেনি।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বছরে প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার টাকা। এই হিসাব অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি কেনার ব্যয় বাদে। টাকা খরচ হয় মূলত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুসরাত জাহান ছাত্রদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা দাবি করে বলেন, ক্যাম্পাস না থাকায় শুধু শিক্ষার্থী নয়, তারাও নানান সমস্যায় ভুগছেন। ক্লাসরুম, শিক্ষকদের বসার ব্যবস্থা ও জ্ঞান চর্চার স্থান না থাকায় শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো পাঠদান করতে পারছেন না তারা। এছাড়া খেলাধুলা ও ক্যান্টিন না থাকার সমস্যা শিক্ষার্থীদের তো রয়েছেই।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে যেনতেনভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা শেষ হচ্ছে। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা কার্যত ঠকছেন। এজন্য আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন ও উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম হাসান তালুকদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২২৫ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ একর জমির ওপর যখনতখন ক্যাম্পাস নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত আট বছরে একটি ইটের টাকাও বরাদ্দ মেলেনি।