ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১

১৪ বছর পর সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা মামলা, আসামীদের আদলত প্রাঙ্গনে মধ্যযুগীয় নির্যাতন

নিজস্ব সংবাদদাতা, পটুয়াখালী।

প্রকাশিত: ১১:১৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১১:১৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

১৪ বছর পর সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা মামলা, আসামীদের আদলত প্রাঙ্গনে মধ্যযুগীয় নির্যাতন

মোঃ জিয়াউর রহমান (৩৪)। মৃত্যু সনদ অনুযায়ি তিনি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছেন ২০১৫ সালে। সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত সেই জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে বলে গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তার ভাই মোঃ তাইফুর রহমান (৩৫)। ঐ দিনই কলাপাড়া থানা পুলিশ মামলা গ্রহন করেন।

মামলা নং-১৪, তারিখ ঃ ১৯-০৯-২৪। এ মামলায় খুনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে ২০১০ সালে। মামলায় আসামী করা হয়েছে ৪১ জনসহ অজ্ঞাত নামা আরো ২০-২৫ জনকে। আসামিরা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী বলে জানা গেছে। অভিযুক্তরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পটুয়াখালী আদালতে হাজিরা দিতে এলে কোর্ট প্রাঙ্গনে আসামী সোহাগ মিয়াকে ইট ও হাতুরি দিয়ে দুই পা থেতলে দিয়েছে পটুয়াখালী বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সোহাগ মিয়াকে সংকটাপন্ন অবস্থায় বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনাটি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের। মোঃ জিয়াউর রহমান পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মস্তফাপুর এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের জারীকৃত মৃত্যুর সনদ সূত্রে জানা যায়, জিয়াউর রহমান জিয়া (৩৪) ২০১৫ সালের ২৫ শে মে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার বাবার নাম মৃত্যু হাবিবুর রহমান। জিয়ার মৃত্যুর স্থান দেখানো হয়েছে গ্রাম মস্তফাপুর, ডাকঘর পাখিমারা, ওয়ার্ড  নং-৯, ইউনিয়ন নীলগঞ্জ, উপজেলা-কলাপাড়া ও জেলা-পটুয়াখালী। নীলগঞ্জ ইউপির মৃত নিবন্ধন বই নং-০২/২০০৯, নিবন্ধন তারিখ ঃ ২৫-৫-২০১৫। নিবন্ধন সনদ ইস্যুর তারিখ ৩০-১০-২৪, নিবন্ধন নং-৭৪২, পৃষ্ঠা নং-৫১। অথচ কলাপাড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নিহত জিয়াউর রহমান জিয়ার ভাইয়ের দায়ের করা মামলা সূত্রে জানাযায়, গত ২০১০ সালের ২৪ শে অক্টোবর সকাল দশটার দিকে আসামিরা তার ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যা কান্ড ঘটানোর ফলে ও তাদের হুমকিতে তরিঘরি করে লাশ নিজ বাড়িতে দাপন করা হয় কোন প্রকার ময়না তদন্ত ছাড়া। সি আর মামলা নাম্বার ১২২৫/২০২৪। জিআর মামলা নাম্বার-১৬৭ /২০২৪। এই তারিখে মামলাটি দায়ের একমাস পরে ৮ অক্টোবর  মামলায় উল্লেখিত তারিখটি ভুল হয়েছে বলে ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর হবে বলে সংশোধনীর আবেদন দেয় আদলতে। যা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য। এদিকে আদালতে দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৮ শে অক্টোবর ঘটনার তারিখ উল্লেখ করা হলেও কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রেকর্ডে দেখা যায় ২০১৫ সালের ২৫ শে মে জিয়াউল হক জিয়া গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি হন। সময় উল্লেখ করা হয় দুপুর ১২টা। সিরিয়াল নাম্বার ৪৩৮৫/১২।

এ ছাড়াও নিহত জিয়াউর রহমান জিয়ার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করে এমডি মাহাবুব খান নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ২০১৫ সালের ২৬ শে মে তার ফেসবুক ভেরিফাই একাউন্টে একটি পোস্ট দেন ' ওই পোস্টে তিনি লিখেন নীলগঞ্জ ইউনিয়ন নিবাসী কলাপাড়া থানার বিএনপি থেকে নেতা পটুয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান ২৫-৫-১৫ ইং তারিখ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। আমি এই ছাত্রনেতার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।  

৫ আগস্ট এর পরিবর্তিত পরিস্থিতি পরে ২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিন তারিখে কলাপাঙা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে  ২০১০ সালের ২৮ শে অক্টোবর তারিখে ঘটনা উল্লেখ করে ১৪ বছর পরে একটি হত্যা মামলা দায়ের করায় বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। এ মামলায় উচ্চ আদালতে থেকে জামিন নিয়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়া আদালতে হাজিরা দিতে আসলে কয়েকজনকে নির্যাতন করা হয়।

প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানান, পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির প্রধান গেটের সামনে গত বুধবার দুপুর ১২ টার দিকে বেশ কয়েক জন আসামীকে মারধর করে গুরুত্বর জখম করা হয়। হামলায় অংশ নেয়া সকলেই পটুয়াখালী বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। এ ছাড়া হামলায় সরাসরি দুই জন আইনজীবী অংশ নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে হামলার সময় উপস্থিত স্থানীয়রা ছবি এবং ভিডিও ধারন করলেও হামলাকারীরা হুমকি দিয়ে জোর পূর্বক হামলার ছবি এবং ভিডিও ডিলেট করতে বাধ্য করেন। হামলায় অপর আহতরা হচ্ছেন মোঃ সোহাগ, সোহাগ মিয়া এবং মোঃ জামাল। এদের মধ্যে সোহাগ মিয়াকে কোমরের নীচে ইট এবং হাতুড়ি দিয়ে থেতলে দেয়া হয়েছে। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গুরুতর আহত সোহাগ কলাপাড়া নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মিয়ার ছোট ভাই।

নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া বলেন, ‘হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আসার পরও আজ আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাদের ১০ থেকে ১২ জনকে মারধর করে আহত করা হয়েছে। আহত করার পর তাদের কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে বসাকবাজার এলাকায় ছেড়ে দেয় হয়। তারা তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করতে দেয়নি। আদালতের মত জায়গায় আজ মানুষের নিরাপত্তা নাই।’

এদিকে আদালত চত্বরে হামলা ও মারধরের ঘটনায় সাংবাদিকরা পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির মাধ্যমে সিসি টিভি ফুটেজ চাইলেও তা পাওয়া যায়নি। তবে পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড.এ.টি এম. মোজাম্মেল হোসেন তপন বলেন, ‘আমি তখন আদালতে ছিলাম, কি হয়েছে তা ঠিক বলতে পারছি না।

এদিকে পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাড.ওয়াহিদ সরওয়ার কালাম বলেন, ‘আদালত চত্বরে এ ধরনের ঘটনা আইনজীবীদের জন্য দুঃখ জনক। এ বিষয়ে সকলের প্রতিবাদ করা উচিত। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দ্যেশ্য করে বলেন, ‘সাংবাদিকদের সাহসী হতে হবে, সত্য তুলে ধরতে হবে।’

পটুয়াখালী সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন ‘আদালত চত্বরে হামলার সংবাদ শুনে আমরা পুলিশ পাঠিয়েছি। তবে এ বিষয় আমাদের কাছে কেউ কোন অভিযোগ করেনি।

এ ব্যপারে কলাপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ জুয়েল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই মামলাটি অধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে যাতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। 

নুসরাত

×