ছবি: বাংলাদেশের গর্ব হালদা
বাংলাদেশের গর্ব হালদা নদী। বৃহৎ রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিগনির প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এটি। এখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। যুগ যুগ ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
মুক্তার দানার মতো সাদা এ ডিম দেশের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক।হালদা নদী শুধু সোনা খ্যাত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নয়, এটি বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির প্রধান উৎস।
পানির বিশেষ গুণগতমান ও পরিমাণের কথা বিবেচনা করে ১৯৮৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে শহরের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে। এ নদীর পানিতে হেভি মেটালের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম হওয়ায় বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসেবে হালদা নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
হালদাকে তুলনা করা যেতে পারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী মেকংয়ের সঙ্গে। মিয়ানমার, চীন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড যৌথভাবে একটি সমন্বিত নদী কমিশন গঠন করে মেকং নদীতে মৎস্য চাষের মাধ্যমে তাদের সারা বছরের মাছের চাহিদা পূরণ করছে।
জানা গেছে, মেকং নদীর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত সমন্বিত নদী কমিশনের যৌথভাবে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদী থেকে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এর ফলে নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত মাছ ধরার জন্য মেকং নদী উন্মুক্ত করে দিলে জেলেরা নদী থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করে।
হালদা নদীকে নিয়েও মেকং নদীর মতো একটি পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ নিতে পারলে জাতীয় মৎস্য অর্থনীতিতে একক নদী হালদার অবদান আরো গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছাবে।
দেশে আরো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যা নিয়ে আমরা বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্যের দাবি জানাতে পারি। চট্টগ্রামের হালদা নদী তেমনি এক সম্পদ। বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণার জন্য ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী হালদা নদী জাতীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও যোগ্যতা রাখে।
হালদা নদীকে জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের।হালদা নদীর পানি বর্তমানে বিভিন্ন কারণে মারাত্মক দূষণের শিকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিল্প কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য, ব্রিক ফিল্ডের দূষণ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকজনিত দূষণ।
হালদা নদীর উপকূলে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে বেশকিছু দূষণকারী শিল্প কারখানা, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী হচ্ছে হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট। এ কারখানা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য যথাক্রমে মাদার্শা ইউনিয়নের মাদারী খাল ও মেখল ইউনিয়নের চ্যাংখালী খাল হয়ে হালদা নদীতে পড়েছে। এতে হালদা নদীর পানি দূষণ, নদীর মূল্যবান মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট এবং আহরিত ডিমের রেণু উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
হালদার প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের আরেকটি কারণ হচ্ছে এর ৩৬টি শাখা খাল, নদী ও ছড়াগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট নির্মাণ, বাঁধ তৈরি এবং রাবার ড্যাম নির্মাণের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
হালদাকে আঁকড়ে থাকা প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবারসহ জড়িয়ে আছে বিশ হাজার মানুষের জীবিকায়ন। নদী গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলত পরিবেশগত। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিম ছাড়ার উপযোগী প্রতিটি মাছের ওজন সর্বনিম্ন পাঁচ কেজি থেকে সর্বোচ্চ এক মণ পর্যন্ত হয়। এসব মাছ ডিম দেয় একসঙ্গে ৫ থেকে ৪০ লাখ পর্যন্ত। বর্তমানে হালদা নদীতে মিঠাপানির ডলফিনসহ ৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে।
জানা গেছে, পঞ্চাশের দশকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগেরও বেশি পোনার চাহিদা পূরণ করত এই হালদা। আগে হালদার যে পরিমাণ মাছ ও ডিম পাওয়া যেত, এখন তার এক চতুর্থাংশও মেলে না।
হালদা খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে নামকরণ হয় হালদা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে মানিকছড়ি, চট্টগাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরের কাছে কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে।
হালদার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। পানির উৎস মানিকছড়ি, ধুরং, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, লেলাং, বোয়ালিয়া, চানখালী, সর্ত্তা, কাগতিয়া, সোনাইখাল, পারাখালী, খাটাখালীসহ বেশ কিছু ছোট ছোট ছড়া। নদীটির গভীরতা স্থান বিশেষ ২৫ থেকে ৫০ ফুট।
তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, হালদায় একসময় ৭২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কালপরিক্রমায় পাঙ্গাশ, ঘনি চাপিলা, কইপুঁটি, বাণী কোকসা, ঘর পুঁইয়া, গুইজ্জা আইর, বুদ বাইলাসহ অন্তত ১৫টি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জানা গেছে, ১৯৪৫ সালে শুধু হালদা থেকেই ৫০০০ কেজি রেণু সংগ্রহ করা হতো। একসময় হালদায় ২০-২৫ কেজি ওজনের কাতলা, ১২-১৫ কেজি ওজনের রুই এবং ৮-১০ কেজি ওজনের মৃগেল পাওয়া যেত, যা এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। মৎস্য অধিদফতরের সংকলন-২০১৩ থেকে জানা যায়, হালদা থেকে ১৯৪৫ সালে সংগ্রহীত ডিম ১,৩৬,৫০০ কেজি এবং ৬৫ বছর পর ২০১১ সালে সংগৃহীত ডিম ১৩০৪০ কেজি। প্রাকৃতিক অ্যাগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রির অপর নাম হালদা.
হালদা নদী বাংলাদেশের সোনার খনি হিসেবেও পরিচিত। জনশ্রুতি আছে, হালদা নদী থেকে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এ নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয়, যোগাযোগ, কৃষি ও পানিসম্পদেরও একটি বড় উৎস।
হালদা বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অনুযায়ী, হালদার ৫ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা একটি মাছ থেকে বছরে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তাই অপার সম্ভাবনাময় এ নদীকে ঘিরে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে জাতীয় অর্থনীতিতে শতকোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনাকে অবহেলা করা ঠিক নয়।
জেনে রাখার মতো বিষয় হলো ডিম থেকে উৎপাদিত রেণু, পোনা থেকে মাছ হিসেবে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতে হালদা নদী চার ধাপে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, হালদায় বর্তমানে মাছ যে পরিমাণে ডিম ছাড়ে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ডিম ছাড়ে কাতলা মাছ। ১৮ থেকে ২০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ ডিম দেয় প্রায় ৪০ লাখ।
একটি মা মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে আয় করা যায়। প্রথম ধাপে ডিম থেকে রেণু বিক্রি করে, দ্বিতীয় ধাপে ধানি পোনা বিক্রি করে, তৃতীয় ধাপে আঙুলি পোনা বিক্রি করে, চতুর্থ ধাপে এক বছর বয়সে মাছ হিসেবে বাজারজাত করে।
বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিটি ধাপে ৪০ শতাংশ মৃত্যুহার বাদ দিয়ে হিসাব করলে একটি মা-কাতলা মাছ প্রতি বছর হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার। এই হিসেবে হালদার প্রতিটি মা-মাছকে একেকটি প্রাকৃতিক অ্যাগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রি বলেও অভিহিত করছেন হালদা গবেষকরা।
শিলা ইসলাম