ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

দখল-দূষণে মৃত জারিরদোনা খাল, অবৈধ দখলদারদের তালিকা হলেও নেই অগ্রগতি!

মো. ফয়েজ, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর

প্রকাশিত: ২২:১৯, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২২:২০, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

দখল-দূষণে মৃত জারিরদোনা খাল, অবৈধ দখলদারদের তালিকা হলেও নেই অগ্রগতি!

ছবি: প্রতিনিধি

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট বাজারে অবস্থিত জারিরদোনা খালটি দখলদারদের কবলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বহুতল ভবন এবং দোকানপাট নির্মাণের কারণে এটি এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।

দুই বছর আগে ৮০ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি হলেও এখনো কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে এ খাল দখল করা হচ্ছে বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের মতে, যে খাল দিয়ে এক সময় পণ্যবাহী নৌকা চলত, সেটি এখন সংকুচিত হয়ে নালায় রূপ নিয়েছে। খালের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উপজেলার হাজিরহাট, চরফলকন, চর জাঙ্গালিয়া, জাজিরাসহ আশপাশের বাসিন্দারা, অবৈধ দখলদার হাজিরহাট বাজারের ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় মেঘনা নদীর জোয়ারের পানি এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং অতিবৃষ্টির পানি খাল দিয়ে বেরিয়ে যেত। এছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে খাল সংলগ্ন ফসলি জমিতে খালের পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ করা হতো। জোয়ারের সঙ্গে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছও খালে এসে পড়ত।

কিন্তু খালের উত্তর অংশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রশস্ত থাকলেও এখন এটি কোনো কাজে আসছে না। বৃষ্টির পানি আর এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হতে না পারায় সামান্য বৃষ্টিতেই আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমেও খাল দিয়ে নদী থেকে পানি আসার সুযোগ নেই।

তাদের অভিযোগ, গত ১৫-২০ বছর ধরে হাজিরহাট বাজারের খালপাড়ে অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় নদীর সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাজারের অংশে খালটি এখন নালায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে হাজিরহাট বাজারের অংশে এই খালের উপর ১১টি বহুতল ভবন এবং ৬৯টি আধাপাকা ও টিনশেড ঘর রয়েছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে জানা যায়, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার সীমান্তে আলেকজান্ডারের বালুরচর এলাকার জারিরদোনা খাল সংলগ্ন বেড়িবাঁধের ওপর থাকা সুইসগেটের উত্তর অংশ থেকে সংযোগ খালটি শুরু হয়।

এটি উত্তরমুখী হয়ে পাটারিরহাট ইউনিয়ন দিয়ে হাজিরহাট বাজারের পশ্চিম পাশ ঘুরে বাজারের উত্তর দিক থেকে কয়েক কিলোমিটার গিয়ে পূর্ব দিকে ফায়ার সার্ভিসের পাশে গিয়ে শেষ হয়। খালের উত্তর এবং দক্ষিণ অংশ পূর্বের অবস্থানে থাকলেও হাজিরহাট বাজার সংলগ্ন খালের মাঝখানের অংশের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।

যাতায়াতের জন্য খালের ওপর অপরিকল্পিতভাবে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ভবনে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসিন্দারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবহৃত বর্জ্য-আবর্জনা ফেলে খালটি ভরাট করে ফেলেছে।

হাজিরহাট বাজার পরিচালনা কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বাজারের সব ময়লা-আবর্জনা এই খালে ফেলা হচ্ছে। এতে খাল দূষিত হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পরে সেখানে অবৈধভাবে দোকানপাট তৈরি করা হচ্ছে।

এছাড়া বাজারের ওপর বেশ কয়েকটি দ্বিতল ও তিনতলা ভবনের বড় অংশ খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। বছরের পর বছর খাল দখল হলেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

হাজিরহাট বাজারের ইফাজ ফার্মেসির মালিক ও স্থানীয় সাংবাদিক শরীফুল ইসলাম বলেন, খালে ময়লা ফেলার কারণে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি হয়েছে। খালের ময়লা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং কোথাও কোথাও পোকা-মাকড় জন্ম নিচ্ছে। এতে এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি হয়েছে।

এক সময়ের বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রবীণ হাজী মোকাদ্দেস মিয়া বলেন, স্বাধীনতার অন্তত ১০ বছর পরেও এই খাল দিয়ে পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত। হাজিরহাট বাজারে সরকারি গুদাম ছিল, যার মালামাল এই খালের মাধ্যমে আসত।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যে খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলত, সেটি এখন নেই বললেই চলে। নদীর জোয়ারের পানির স্রোত যেখানে প্রবাহিত হতো, সেখানে এখন বৃষ্টির পানিও গড়িয়ে যেতে পারে না।

কমলনগর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইউসুফ আলী মিঠু বলেন, খাল উদ্ধারে প্রশাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বরং তাদের গাফিলতির কারণে দিন দিন অবৈধ দখলদাররা খালকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে কমলনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঝন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, হাজিরহাটে জারিরদোনা শাখা খালটি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। এই খালের ওপর থাকা অবৈধ ৮০ জন দখলদারের একটি তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই সেখানে অভিযান চালিয়ে খালটি দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

দৃশ্যমান এই খালটি বহুতল ভবন এবং স্থাপনার নিচে চাপা পড়ে গেছে। অবৈধ দখলদারদের থেকে খালটি উদ্ধার এবং সংস্কারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এম.কে.

×