সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি
শেষ হতে চলেছে অপেক্ষার পালা। হাতে রয়েছে শুধু আজকের দিনটি। কাল শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে বাঙালির মননের উৎকর্ষতার প্রতীক ভাষাশহীদদের স্মৃতি নিবেদিত অমর একুশে বইমেলা। সেই সুবাদে বৃহস্পতিবার মেলার দুই ক্যানভাস সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি আঙিনায় দেখা মেলে সুন্দরতম দৃশ্যচিত্র।
নির্মাণশ্রমিকদের তুমুল কর্মযজ্ঞে দাঁড়িয়ে গেছে অধিকাংশ স্টল কিংবা প্যাভিলিয়নের কাঠামো। দেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসবটি ঘিরে চলছে এখন শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি। রং করা, নান্দনিক নকশা গড়াসহ স্টলের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে মেলা মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রকাশকরা।
বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবছরও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অবহ জুড়ে যাবে বইমেলার শরীরে। সেই বাস্তবতায় এবারের মাসব্যাপী মেলার প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। শনিবার বেলা তিনটায় প্রধান অতিথি হিসেবে বইমেলা উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেবেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. রেজাউল করিম বাদশা এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মফিদুর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হবে।
গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবার বইমেলার বিন্যাস ও নকশা করা হয়েছে। এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে সর্বোচ্চসংখ্যক ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি স্টল থাকবে। সব মিলিয়ে মোট ইউনিট ১০৮৪টি। গত বছর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি এবং ইউনিট ছিল ৯৪৬টি। এবার মেলায় ৩৭টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি প্যাভিলিয়ন থাকবে।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বর থাকছে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিশুচত্বরে থাকবে ৭৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং ইউনিট ১২০টি। গত বছর এই চত্বরে অংশ নিয়েছিল ৬৮টি শিশুতোষ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমিসহ মেলায় অংশগ্রহণকারী সকাল প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে।
এবার বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুণœ রাখা হয়েছে তবে কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মেলার বাহির-পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির-গেটের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্লান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট ৪টি প্রবেশ ও বাহির-পথ থাকবে।
বৃহস্পতিবার মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন বইমেলার সদস্য সচিব ড. সরকার আমিন। একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম একুশে বইমেলা ২০২৫-এর বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন একাডেমির সচিব ড. মো. সেলিম রেজা, জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) জি এম মিজানুর রহমান এবং মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ড্রিমার ডংকি-এর সিএমও রাকিব হাসান রাজ।
এবারের বইমেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রকাশিত বইগুলো প্রদর্শনে কোনো প্রতিবন্ধকতা বা নিষেধাজ্ঞা থাকবে কিনাÑএমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আজম বলেন, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যেহেতু বাংলা একাডেমি থেকে গত কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অর্ধশতাধিক বই প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলোর বিক্রি বা প্রদর্শনে কোনো বাধা থাকবে না। একইভাবেই অন্যান্য প্রকাশনীর প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুবিষয়ক নিয়েও কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না।
তবে কোনো প্রকাশনী যদি স্বেচ্ছায় বই ডিসপ্লে থেকে বিরত থাকে সেখানে একাডেমি থেকে কাউকে বই প্রদর্শনে উৎসাহিত করা হবে না। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শন বা বিক্রি নিয়ে কোনো মব জাস্টিস হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা হবে। বইমেলাকে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর, কাক্সিক্ষত ও গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনগুলোর একটি আখ্যা দিয়ে মোহাম্মদ আজম বলেন, বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে এটি সফল হবে।
জাতীয় এই আয়োজনকে নিজের মনে করে সবার অংশগ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় যে পরিসর রয়েছে তার জন্যও এই বইমেলা অত্যন্ত জরুরি।
লিখিত বক্তব্যে সরকার আমিন বলেন, জ্ঞানভিত্তিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বই এবং বইমেলা সহায়ক। তাই সকল সম্ভাবনায় আলোকিত হবে এবারের বইমেলা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবার মেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ৪৩টি ও পুনর্মুদ্রিত ৪১টি বই। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন এবং শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য ১টি স্টল থাকবে। অমর একুশে উদ্যাপনের অংশ হিসেবে শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকছে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা এবারও থাকবে।
প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
এ ছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ-বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে।
বইমেলার সময়সূচি : ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে আটটার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ৮ই ফেব্রুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্যতীত প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে। একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টা থেকে এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।