ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

আগের চেয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে ॥ আইজিপি

টঙ্গীতে শূরায়ে নেজামের বিশ্ব ইজতেমা শুরু কাল থেকে

নূরুল ইসলাম, টঙ্গী

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

টঙ্গীতে শূরায়ে নেজামের বিশ্ব ইজতেমা শুরু কাল থেকে

প্রথম পর্বের ‘বিশ্ব ইজতেমা’ উপলক্ষে গাজীপুরের টঙ্গীতে তুরাগ নদের তীরে জড়ো হতে শুরু করেছেন মুসল্লিরা।

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্যান্ডেলের চট টানানোর কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন না হলেও ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে একটানা ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শূরায়ে নেজামের তথা জোবায়েরপন্থিদের তবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা টঙ্গীতে আসা শুরু করেছেন।
রাজধানী ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গী তুরাগ নদের তীরে এ বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন। সম্প্রতি ইজতেমা ময়দানে সাদপন্থিদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় জোবায়ের-সাদ গ্রুপের সংঘর্ষে ৪ মুসল্লি নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনার শঙ্কা কাটিয়ে মুসল্লিরা বুধবার বিকেল থেকেই দলে দলে ইজতেমা ময়দানে আসা শুরু করেছেন। আয়োজকরা আশা করছেন মুসল্লিদের ভিড়ে ইজতেমা শুরুর আগের রাতেই মাঠ পূর্ণ হয়ে যাবে।
দেশের অর্ধেক জেলার সাথীদের নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত এক ধাপ, আবার ২ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরেক দাপে ৩ দিন ৩ দিন বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের আয়োজন। দুই ধাপেই থাকছে শূরায়ে নেজামের আখেরি মোনাজাত। কথা রয়েছে ৪ ফেব্রুয়ারি জোবায়েরপন্থিদের বিশ্ব ইজতেমা শেষে ৮ দিন বিরতি দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে সাদপন্থিদের ৩ দিনের বিশ্ব ইজতেমা।
ইজতেমা আয়োজন উপলক্ষে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে বুধবার  এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, এবারের বিশ্ব ইজতেমা আগের চেয়ে আরও কড়া নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। যে কোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের চেয়ে আরও সজাগ ও সতর্ক রয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় সাত হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে।

এ ছাড়াও বিশ্ব ইজতেমার পক্ষ থেকে তবলিগের কাজে নিয়োজিত প্রায় দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। শূরায়ে নেজাম ৩১ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি আর সাদপন্থিরা ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করবে।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাইনোকুলারের মাধ্যমে ইজতেমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইজতেমা ময়দানের অভ্যন্তরে প্রতিটি
খিত্তায় সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। বিবদমান দু’গ্রুপই শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমা পালন করবেন। শূরায়ে নেজাম বা জোবায়েরপন্থিরা ৩১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ইজতেমা অনুষ্ঠান করবেন আর সাদপন্থিরা করবেন ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি।

সম্প্রতি ইজতেমা মাঠে একাধিক খুনের ঘটনা উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, আমরা আদম সন্তান। দুই পক্ষই আমল করেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে, দুই পক্ষ একমত হওয়ায় আমরা আশা করি ইজতেমা সুন্দর হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত আইজিপি আকরাম হোসেন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান, অতিরিক্ত ডিআইজি জাহিদুল ইসলাম ভূইয়া, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জাহিদুল হাসান, তাহেরুল হক চৌহান, গাজীপুরের পুলিশ সুপার চৌধুরী জাবের সাদেক, টঙ্গী পূর্ব-পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান, ফরিদুল ইসলাম, প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান, গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মনজুরুল করিম রনি, সরকার জাবেদ আহমেদ সুমন, শাহাবুদ্দিন ও বেনজীর খানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। 
সাদপন্থি মিডিয়া মুখপত্র মোহাম্মদ সায়েম বুধবার জনকণ্ঠকে বলেছেন, টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আর কোনো দিন সাদপন্থিরা বিশ্ব ইজতেমা করবে না এমন একটি শর্তের কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। এটি একটি দুর্ভিসন্ধিমূলক প্রচারণা।

এমন কোনো শর্তে সাদপন্থিরা ৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা করার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানাচ্ছেন, সাদপন্থিদের বাংলাদেশের আমির ওয়াসেফুল ইসলাম। শর্ত ছাড়াই নির্ধারিত তারিখে তাদের বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠান হবে। 
এদিকে বিবদমান শূরায়ে নেজাম ও সাদপন্থিদের নানা বিশ্লেষণ বলছে, সরকার, শূরায়ে নেজাম ও সাদপন্থিদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হলেও বিবদমান দুটি গ্রুপ যে যার মতো করে বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করায় স্থানীয় প্রশাসন বিপাকে পড়ে। দুপক্ষের ঘোষিত তারিখ মাথায় রেখে প্রশাসনও সেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
এদিকে তবলিগ জামাতের এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মুসল্লি ও গাজীপুর সিটির নাগরিকরা। তারা বলছেন, আমরা মারামারি কাটাকাটি রেষারেষি হামলা সংঘর্ষ রক্তারক্তির বিশ্ব ইজতেমা চাই না। ইজতেমা শুরুর আগে-পরে দীর্ঘ সময় ধরে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির ভিড়ে পুরো টঙ্গী অচল হয়ে পড়ে। সকল যোগাযোগ কাঠামো ভেঙে পড়ে।

স্কুল-কলেজ-কর্মস্থলে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেমে যায়। তাই টঙ্গীর নাগরিকরা আগের মতো মিলেমিশে এক পর্বের একবারই বিশ্ব ইজতেমার দাবি করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১৮ ডিসেম্বর ইজতেমা ময়দানে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাদপন্থিদের একজন সাথী মিজানুর রহমান (৪২) মারা যাওয়ার খবর দিয়েছেন সাদ মুখপাত্র মোহাম্মদ সায়েম। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনায় দুজন বেলাল হোসেন ও মিজানুর রহমান সাদপন্থিদের সাথী বলে দাবি করা হয়েছে। 
শূরায়ে নেজাম বা জোবায়েরপন্থিদের সাফ কথা বিশ্ব ইজতেমায় গত ১৮ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা চলাকালে হামলায় হতাহতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ইজতেমা অনুষ্ঠান করার অধিকার হারিয়েছে সাদপন্থিরা। সাদপন্থিরা কোনোভাবেই বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ইজতেমা করার অধিকার রাখে না।
বুধবার বিকেলে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এক বর্গকিলোমিটারের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে বিদেশী মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ময়দানের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বয়ান মঞ্চ। সরকারিভাবে টয়লেট গোসলখানা ও খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে মাঠের চারপাশে। মাঠজুড়ে শব্দ প্রতিরোধক মাইক লাগানো হয়েছে। মাঠের পূর্ব দিকের তিন ভাগের এক ভাগ জায়গায় বাঁশের খুঁটি লাগানো হলেও শামিয়ানা বা চটের ছাউনি টানানো হয়নি এখনো।
শূরায়ে নেজামের আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জনকণ্ঠকে বলেছেন, যে অংশটুকুতে চট টানানো হয়নি সে অংশে তবলিগের সাথীরা ত্রিপল, তাঁবু বা শামিয়ানা সঙ্গে করে নিয়ে এসে টানিয়ে নেবেন এমন সব তথ্য সাথীদের আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুসল্লিদের তুরাগ নদে পারাপারে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা পাঁচটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়াও ফেরিঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।

পুরো ইজতেমা ময়দানকে ৩৩৫টি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ইজতেমায় এবার ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।  এ ছাড়া র‌্যাবের হেলিকপ্টার আকাশপথে টহল এবং নৌ-পুলিশের সদস্যরা তুরাগ নদে স্পিডবোট দিয়ে টহল দেবেন।
ইজতেমা ময়দানের আশপাশে বিশটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে  বাইনোকুলারের মাধ্যমে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইজতেমা ময়দানের অভ্যন্তরে প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। টঙ্গী টেশিস মাঠে পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং মন্নু টেক্সটাইল কম্পাউন্ডে র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণে মন্নু টেক্সটাইল কম্পাউন্ডে থাকছে দেশের নানা স্থান থেকে আসা নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।
ইজতেমা আয়োজন উপলক্ষে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, এবারের বিশ্ব ইজতেমা আগের চাইতে আরও কড়া নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। যে কোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের চাইতে আরও সজাগ ও সতর্ক রয়েছে।

বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় সাত হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়াও বিশ্ব ইজতেমার পক্ষ থেকে তবলিগের কাজে নিয়োজিত প্রায় দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

×