ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

শহীদ পরিবারের সদস্য ও বেঁচে ফেরা সেনা অফিসারদের সংবাদ সম্মেলন

অভিযুক্ত-সাজাপ্রাপ্ত বিডিআর জওয়ানদের নিরপরাধ বলার সুযোগ নেই

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

অভিযুক্ত-সাজাপ্রাপ্ত বিডিআর জওয়ানদের নিরপরাধ বলার সুযোগ নেই

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন পিলখানায় শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী, মদতদাতা ও সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমেই দ্রুত বিচার সম্পন্নের জোর দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও বেঁচে ফেরা সেনা অফিসাররা।
তারা বলছেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর হত্যাকা-ের নেপথ্যে দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্র জড়িত আছে বলে জাতি বিশ্বাস করে। যা বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশনের অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসবে। অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত বিপথগামী জওয়ানদের নিরপরাধ বলার কোনো  সুযোগ নেই। তাদের মুক্তির দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
বুধবার রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে এ দাবি করা হয়। পিলখানায় শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্যে বলেন, পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ ও ভয়াবহ ম্যাসাকার।

সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কর্তব্যরত নিরস্ত্র নিরপরাধ ৫৭ বিডিআর অফিসার তথা সেনা কর্মকর্তাকে, লাশ বিকৃত করা হয়, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ট্রাকে লোড করা হয়, পৈশাচিকভাবে লাশকে ক্ষতবিক্ষত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়, ড্রেনে ফেলে দেওয়া হয় ও গুম করা হয়, পৈশাচিকভাবে অফিসার পরিবারকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়।

সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নিরীহ নিরপরাধ নারী ও শিশুদের টেনেহিঁচড়ে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে ধরে এনে কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করা হয়, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বেশিরভাগ অফিসারকেই শারীরিক নির্যাতন করা হয়, অফিসারদের বাসস্থানে ব্যাপক ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ চুরি ডাকাতি করা হয়, অফিসারদের গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, ব্যক্তি ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংসের মাধ্যমে পিলখানাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়।  
তিনি বলেন, বিপথগামী বিডিআর জওয়ান কর্তৃক ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ওই অপরাধের চাক্ষুষ সাক্ষী আমরা শহীদ পরিবার, বেঁচে ফেরা অফিসাররা এবং আপনাদের মিডিয়ার ছবি ও ভিডিও যা সারা পৃথিবী অবলোকন করেছে।
বুশরা বলেন, সেদিন পিলখানায় প্রায় ৫ হাজার বিডিআর সদস্য এবং ৪ হাজারের মতো অস্ত্র মজুত ছিল। বিডিআর জওয়ানরা আধা ঘণ্টার মধ্য অস্ত্রাগার লুট করে সকল অস্ত্র বের করে নেয় এবং সরাসরি হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করে। সেদিন যে শুধু পিলখানায় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে তা নয়, বিপথগামী বিডিআর সৈনিক কর্তৃক উসকানির মাধ্যমে সারাদেশের রাইফেল ব্যাটালিয়ন ও ট্রেনিং সেন্টারে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
কার্নেজে পরবর্তী তৎকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত আনিসুজ্জামান তদন্ত কমিশন, সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত সেনা তদন্ত, সিআইডি তদন্ত এবং বিডিআর ইউনিট তদন্তে রাজনৈতিক কারণে পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা বেরিয়ে আসেনি। তবে তাদের তদন্তে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের সরাসরি অংশগ্রহণে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ম্যাসাকার সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

পর্যাপ্ত প্রমাণ এবং শহীদ ও বেঁচে ফেরা অফিসারদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সিভিল কোর্ট ও বিডিআর কোর্টে বিপথগামী জওয়ানদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা প্রদান করা হয়। আরও বলা হয়, সিভিল আদালতে হত্যা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের মামলা পরিচালনা করা হয়। যথাযথ বিধি অনুসরণে এবং অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে বিডিআর অর্ডিনেন্সের আওতায় বিডিআর কোর্টে বিদ্রোহের মামলায় জওয়ানদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।  
বুশরা বলেন, বিডিআর কোর্টের সাজা নিয়ে প্রশ্ন করা মানে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অফিসারদের তথা সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। অতএব অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত বিপথগামী জওয়ানদের নিরপরাধ বলার কোনো সুযোগ নাই এবং তাদের মুক্তির দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাই আমাদের একান্ত দাবি, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের প্রাপ্য সাজা অবিলম্বে কার্যকরের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে বাহিনীটিকে কলঙ্কমুক্ত করা হোক। সঠিক বিচার না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

গত ৫ আগস্ট পরবর্তী নিয়োগ প্রাপ্ত আইনজীবীরা বিডিআর মামলায় সম্পূর্ণ নতুন। এত বড় ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। বর্তমানে চলমান মামলা পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে যথাযথ আইনি লড়াই চালু রাখা এবং এর মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের যথাযথ শাস্তি প্রদানে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে একান্ত অনুরোধ জানান তিনি।  
বুশরা বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বিডিআর কার্নেজে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত সৈনিক ও তাদের পরিবারকে গত ১৫ বছর কোনো দাবি নিয়ে মাঠে আসতে আমরা দেখিনি। কিন্তু আজ তারা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবি নিয়ে বিপথগামী সৈনিকদের নিরপরাধ দাবির আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করার অপচেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান।

তাদের এই দাবির মাধ্যমে জাতির দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে প্রকৃত খুনিদের আড়ালের মাধ্যমে বর্তমানের ছাত্র জনতার সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সেনা অফিসার ও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপপ্রয়াস বলে প্রতীয়মান। এই খুনিদের যথাযথ বিচার না হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে যা মোটেও কাম্য হতে পারে না।
পৃথিবীর ইতিহাসে একদিনে ৫৭ জন বিডিআর তথা সেনা অফিসার হত্যার নজির নেই। তাই ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবস ঘোষণার জন্য শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হয়।  
এসময় উপস্থিত ছিলেন পিলখানায় শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীর সন্তান অ্যাডভোকেট সাকিব রহমানসহ অন্যান্য শহীদ পরিবারবর্গ ও বেঁচেফেরা একাধিক সেনা কর্মকর্তা।

×