পাতা ঝরার কাল এখন। শুকনা পাতা ঝরে পড়ছে অবিরত। রাজধানীর রমনা পার্কের ছবি
ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে।/অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে...। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ। কবিগুরু ঝরাপাতার দলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন। এখন সেই পাতাঝরার কাল। ‘জল উঠেছে ছল্ছলিয়ে, ঢেউ উঠেছে দুলে/মর্মরিয়ে ঝরে পাতা বিজন তরুমূলে।’ বিজন তরুমূলে এখন ঝরাপাতার স্তূপ। শুকনো পাতারা গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে পাতাঝরা শুরু হয়। বৃষ্টিহীন রুক্ষ শুষ্ক সময়ে ব্যাপক হারে পাতা ঝরে। অনেক গাছ দেখে জাত চেনা যায় না। শাখা প্রশাখাকে চুলোর শুকনো খড়ি বলে মনে হয়। সব গাছের নিচেই কমবেশি বিছানো থাকে পাতা। যেখানে অনেক গাছ সেখানে পাতাও বেশি। এত বেশি যে, হেঁটে যাওয়ার সময় পা দেবে যায়। মর্মর শব্দ হয়।
শব্দটা অদ্ভুত। কখনো একে শ্রুতিমধুর গান মনে হয়। কখনোবা বিষণœ ভাঙনের সুর হয়ে কানে বাজে। ঝরা পাতার সঙ্গে মানুষের জীবনেরও অনেক মিল। খুব প্রাণবন্ত মানুষটিও এক সময় হারিয়ে যায়। ঝরে যায়। ঝরা পাতারা প্রিয়জন হারানোর বেদনার কথা মনে করিয়ে দেয়। বিচ্ছেদের ক্ষত নতুন করে জাগিয়ে তুলে। পাতা ঝরার দৃশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।’ ঝরে যাওয়া পাতা মানে যেন বিদায়। এই ঝরে যাওয়া মানে একসঙ্গে ছিলাম, আর থাকা হলো না!
এবারও প্রকৃতির নিয়ম মেনে শীতের শুরুতে, মানে, পৌষে পাতাঝরা শুরু হয়েছিল। এখন মাঘের মাঝামাঝি। ফলে বেশিরভাগ পুরোনো প্রাণহীন পাতা ঝরে পড়েছে। ঢাকার রমনা পার্কে কত শত গাছ! সবুজ উদ্যান দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। তবে এখন গেলে দেখতে পাবেন ন্যাড়া হয়ে যাওয়া অনেক গাছও। পত্রশূন্য ডালপালার নিচে শুকনো পাতার স্তূপ।
ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা নিচের দিকে দেবে যায়। মচ্ মচ্ শব্দ হয়। শুকনো পাতার নূপুর বাজা বোধহয় একেই বলে। মৃদু হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে ঝরছে পাতা। একটু জোরে হাওয়া বইলে পাতারা নৃত্য করতে করতে নিচে নেমে আসে!
পার্কের মাঝামাঝি অংশের অনেকটা জায়গা বেশ খোলামেলা। চারপাশ ঘিরে থাকা গাছের শুকনো পাতারা এখানে ব্যাপক হারে পড়েছে। কোনটি কোন্ গাছের পাতা, কে বলবে? দেখে তা বোঝার উপায় নেই। একই রং। একই রকম মচমচে। পাতার নিচে আরও অনেক পাতা। কয়েকটি স্তর। পা ফেলতেই আব্দুল জব্বারের বিখ্যাত গানটির কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘আমি তো দেখেছি কত যে স্বপ্ন মুুকুলেই ঝরে যায়/শুকনো পাতার মর্মর বাজে কত সুর বেদনায়।’
অবশ্য শুধু বেদনা নয়, ঝরাপতা হাসি আনন্দেরও সঙ্গী হচ্ছে। বড়দের সঙ্গে উদ্যানে বেড়াতে আসা শিশুরা মনের আনন্দে পাতা কুড়োচ্ছে। হাতভর্তি করে পাতা নিয়ে শূন্যে ছুড়ে মারছে তারা। সেই পাতা পরোক্ষণেই নিজের গায়ে এসে পড়ছে। তাতেই আনন্দ। ছিন্নমূল শিশুরা আবার খেলা নয়, পাতা কুড়িয়ে বস্তা ভর্তি করায় ব্যস্ত। এটি তাদের নিত্যদিনের কাজ। জীবিকার অংশ।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পাতা কুড়োতে দেখে মনে পড়ে যায় প্রিয় পঙ্ক্তি: ‘পাতাকুড়োনির মেয়ে তুমি কি কুড়োচ্ছ? পাতা, আমি পাতা কুড়োই!/কয়টি মেয়ে ঝরাপাতা : ঝরছে কবে শহরতলায়,/শিরায় তাঁদের সূক্ষ্ম বালু,/পদদলিত হৃদয় ক’টি, বৃক্ষবিহীন ঝরাপাতা/কুড়োই আমি তাদের কুড়োই...।’
আবার এটাও সত্য যে, গাছে গাছে নতুন করে জন্মাবে সবুজ পাতা। সেই সুযোগ করে দিতেই পুরনো মলিন ম্লান পাতারা স্বেচ্ছায় ঝরে পড়ছে। বস্তুত একদিকে শুকনো মরা পাতা ঝরছে, অন্যদিকে গজাচ্ছে নতুন পাতা।