ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

মানিকগঞ্জে অস্তিত্ব সংকটে ১৪ নদী

নিজস্ব সংবাদদাতা, মানিকগঞ্জ ও ঘিওর

প্রকাশিত: ২১:১৪, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

মানিকগঞ্জে অস্তিত্ব সংকটে ১৪ নদী

ঘিওর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর বুকে বোরো ধানের চাষ করা হচ্ছে

ঘিওরে প্রমত্ত পদ্মা-যমুনা,কালীগঙ্গা-ধলেশ্বরী-ইছামতীসহ ১৪টি নদী এখন মৃতপ্রায়। সমস্ত নদীর বুকে এখন শুধু ধু ধু বালুচর। দীর্ঘদিন আগেও ছিল পানির প্রবাহ ও প্রাণের স্পন্দন। নাব্য হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে মানিকগঞ্জের নদীগুলো। মরা নদীর বুকে এখন  ধানের চাষাবাদ হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের প্রায় পুরো সময়টাই থাকে পানিশূন্য। কোথাও গরু চরানো কিংবা দুরন্ত কিশোর -কিশোরীদের ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে। মানুষজন হেঁটে পার হচ্ছে ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, ইছামতীর বুক দিয়ে। ৪ যুগ আগেও এই নদীতে চলত বড় বড় ফেরি,  লঞ্চ ও জাহাজ। অনেক নদীতে হাঁটুর নিচে পানি দেখা যাচ্ছে। এখানে গরু-মহিষ গোসল করানো হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষজন নদীগুলো শাসন করার আহবান জানিয়েছেন।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, জেলাতে কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতীসহ মোট ১৪টি নদী রয়েছে। মোট আয়তন ১ হাজার ৩৭৯ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ২৪১ কিলোমিটার নদী এলাকা।
কালীগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৭৮ কিলোমিটার, প্রস্থ ২৪২ মিটার। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দৌলতপুরে চরকাটারি এলাকায় যমুনা থেকে উৎপন্ন হয়ে কালীগঙ্গা ঘিওর উপজেলার আশাপুরের পাশ দিয়ে জাবরা, দুর্গাপুর ও তরা এলাকায় ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে। এখান থেকে গালিন্দা, নবগ্রাম, চরঘোসতা, আলীগর চর, শিমুলিয়ায় এসে পদ্মার সঙ্গে মিশেছে। বর্তমানে এখান থেকে আরও খানিকটা এগিয়ে হাতিপাড়া, বালুখন্দ,পাতিলঝাপ, শলা হয়ে আলীনগরে এসে ধলেশ্বরীতে মিশেছে। ৮০ দশকের শুরুর দিকেও কালীগঙ্গা দিয়ে বড় বড় ফেরি-লঞ্চ চলতে দেখা গেছে। বর্তমানে কালীগঙ্গার বুকে পানির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বৃহৎ এ নদীটির দুরবস্থার কারণে শুধু নৌযান চলাচলই বন্ধ হয়নি, নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হাজার হাজার জেলে পরিবারেও চলছে দুর্দিন। নদীতে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। অনেকেই মাছ ধরার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা পেশা বদল করতে পারেননি তাদের জীবন কাটছে মানবেতরভাবে। নদী মরে যাওয়ার ফলে কৃষিনির্ভর এ এলাকার সেচ কাজও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আরিচায় পদ্মা নদীর অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। মাঝেমধ্যে আরিচা-দৌলতদিয়া, কাজরহাট নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে একটি বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে পদ্মা নদীর বিভিন্ন স্পটে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে হাজার হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
মানিকগঞ্জ সদরের বেউথা, বান্দুটিয়া, পৌলী এবং তরা, উত্তর তরা কালীগঙ্গায় বিশাল বিশাল চর পড়েছে। চরে আবাদ হচ্ছে। অনেক জায়গায় চলছে নদী দখলের নানা কর্মযজ্ঞ। জয়নাল উদ্দিন (৮২), হাবিব মিয়া (৫৫), আবুল হোসেন (৮২) সহ অনেকেই জানান, ঘিওর উপজেলার উত্তর তরা নদীর পাড়ে তাদের বাড়ি। ১৫/২০ বছর আগেও এত খারাপ অবস্থা ছিল না।  নদীর  পাশে তাদের বাড়িঘর ছিল। তারা এক সঙ্গে মাছ ধরতেন, গোসল করতেন। এ ছাড়া ঘরের কাজ এবং কৃষিকাজ নদীর পানি দিয়েই করতেন। এখন নদীতে পানি নেই। বেশিরভাগ জায়গা ভরাট হয়ে ও দখল হয়ে গেছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেচ কাজে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তরা কালীগঙ্গা নদী পাড়ের মির্জাপুর গ্রামের তাপশ রাজবংশী (৪২) বলেন, আমার বাপ-দাদার আমল থেকে এই নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। বর্তমানে বর্ষাকাল ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। নদীর পানিতে মাছ নেই। বিগত ৭/৮ বছর যাবৎ তাই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। জীবিকার তাগিদে এখন অটোবাইক চালিয়ে সংসার চালাই। মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ইউসুফ আলী জানান, অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো নদী আর এর জন্যই এদেশের জমি যথেষ্ট উর্বর। প্রতিবছর নদী ভাঙনের ফলে মাটি ও পলিতে নদী ভরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে দখল, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নদী শাসনের ফলে নদীর এই দৈন্যদশা।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটিএর আওতায় কালীগঙ্গা খনন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও ঘিওরের পুরাতন ধলেশ্বরী দৌলতপুরের বাঘুটিয়া, হরিরামপুরের কাঞ্চনপুরে নদী ভাঙন রোধে ও স্বাভাবিক স্রোতধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ চলমান রয়েছে। মানিকগঞ্জে ১৪টি নদীতে স্থায়ীভাবে কাজ করার জন্য ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

×