অমর একুশে বইমেলা
আসছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আগামী পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে নিবেদিত বাঙালির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব অমর একুশে বইমেলা। বর্তমানে চলছে চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতি। সেই সুবাদে এখন দারুণ সরব বাঙালির মননের উৎকর্ষতার প্রতীকী এ মেলার দুই ক্যানভাস সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি আঙিনা। দুই প্রান্তে দৃশ্যমান হচ্ছে স্টল থেকে প্যাভিলিয়ন নির্মাণের ব্যস্ততম কর্মযজ্ঞ।
ইতোমধ্যে একাডেমি প্রান্তের মেলা মঞ্চ ও নজরুল মঞ্চের কাঠামো অনেকখানি দাঁড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে উদ্যান অংশের কাঠামো নির্মাণকাজও ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। আগামী ২৯ থেকে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে স্টল, প্যাভিলিয়ন, মঞ্চসহ বইমেলাকেন্দ্রিক বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণ কাজ।
বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবছরও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আবহ জুড়ে যাবে বইমেলার শরীরে। মেলার অঙ্গসজ্জা থেকে প্রতিপাদ্যে থাকবে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিচ্ছবি। সেই বাস্তবতায় এবারের মেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘জুলাই শিক্ষার্থী গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। এ ছাড়া মেলার বিন্যাসের সঙ্গেও থাকবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সম্পৃক্ততা।
সেই বিবেচনায় ২০২৫ সালের বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ বিভক্ত হবে পাঁচটি চত্বরে। এই চত্বরগুলোর মধ্যে রয়েছে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারÑএই চার ভাষাশহীদের নাম। আরেকটি চত্বর বিন্যস্ত হবে জুলাই অভ্যুত্থানের সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি। শহীদদের প্রতিকৃতিসহ নানাভাবে সজ্জিত হবে এসব চত্বর। এ ছাড়া এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর ও শিশু কর্নারে সাজসজ্জায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আলোকসজ্জা ও নকশার সমন্বয়ে এই দুই চত্বরকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হবে।
আগামী পয়লা ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটায় মাসব্যাপী অমর একুশের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে এবারের মেলা উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্ট মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
ইতোমধ্যে লটারির মাধ্যমে বইমেলার স্টল বরাদ্দের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সে অনুযায়ী উদ্যান অংশে সৃজনশীল প্রকাশনীসমূহকে নির্ধারিত জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারের মেলায় প্যাভিলয়ন বরাদ্দ পেয়েছে ২৬টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ৪ ইউনিটের স্টল থাকবে ২৬টি। তিন ইউনিটের স্টল থাকবে ৪৮টি। দুই ইউনিটের স্টলের সংখ্যা ১৩৮টি। এক ইউনিটের স্টলের সংখ্যা ১৬২টি।
শিশু কর্নারে তিন ইউনিটের স্টল থাকবে ৭টি, দুই ইউনিটের ২৩টি ও এক ইউনিটের ২৮টি। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে থাকবে ৭৯টি প্রকাশনা সংস্থার স্টল। এ ছাড়া মেলায় এবার নতুন ৮৫টি প্রকাশনা সংস্থা স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। সব মিলিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে ৬২২টি সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল।
অন্যদিকে বাংলা একাডেমি আঙিনায় এক, দুই, তিন ও চার ইউনিট মিলিয়ে থাকছে শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমিসহ ৯৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সামাজিক সংগঠনের স্টল। মেলার দুই অংশ মিলিয়ে স্টলের সংখ্যা এবার ৭১৫টি। শনিবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উদ্যান অংশের স্টল নির্মাণের প্রস্তুতি ৬০ শতাংশ এগিয়ে গেছে। তবে প্যাভিলিয়ন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম।
কারণ, মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এবার প্যাভিলিয়নের চারপাশ খোলা রাখার পরিবর্তে ঘিরে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের বিপরীতে চারপাশ খোলা রেখে প্যাভিলিয়ন তৈরির আবেদন জানিয়ে বাংলা একাডেমিকে চিঠি দিয়েছেন প্যাভিলিয়ন পাওয়া প্রকাশকরা। তারা বলছেন, প্যাভিলিয়নগুলোর পরিসর কম হওয়ায় সেগুলো ঘিরে দিলে পাঠকদের জন্য অসুবিধা হবে।
একইভাবে প্রতিটি প্যাভিলিয়নের বিপুলসংখ্যাক বই সাজিয়ে রাখতেও সমস্যা হবে। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত এ বিষয়ে একাডেমি থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলশ্রুতিতে প্যাভিলিয়নপ্রাপ্ত প্রকাশকরা চারপাশ খোলা রেখে কাঠামো গড়বেন নাকি পুরোটা ঘিরে তৈরি করবেন সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন।
মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি সূত্র জানায়, গত বছরের নকশাকেই প্রাধান্য দিয়ে এবার মেলা সাজানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে মেলার প্রবেশদ্বার থাকবে চারটি। এগুলো হলো টিএসসির উল্টোপিঠের প্রবেশদ্বার, বাংলা একাডেমির উল্টোদিকের প্রবেশদ্বার, রমনা কালী মন্দিরের নিকটবর্তী প্রবেশ পথ ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসংলগ্ন প্রবেশদ্বার।
এর মধ্যে পাঠক ও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের নিকটবর্তী প্রবেশদ্বারটি সুসজ্জিত করে সাজানো হবে। এই অংশেই স্ন্যাকস আইটেম ও কফি শপের দোকান থাকবে। দর্শনার্থীদের কাছে যেন দৃষ্টিকটু না লাগে সেই বিবেচনায় খাবার দোকানগুলোকে একটি বেষ্টনীর মধ্যে ঘিরে দেওয়া হবে।
চার প্রবেশপথের মধ্যে টিএসসির প্রবেশদ্বার থেকেই শুরু হবে মেলা। এই অংশের ডান দিকের পুরো অংশজুড়ে থাকবে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্যাভিলিয়ন ও স্টল। আর উদ্যানের বাম দিকের অংশে ফায়ার সার্ভিসসহ সেবামূলক ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ থাকবে। এই অংশেই থাকবে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ।
গত বছরের ধারাবাহিকতায় স্টল বা প্যাভিলিয়নসমূহ নান্দনিকভাবে বিন্যস্ত হবে। যাতে করে পাঠকদের স্টল খুঁজে পেতে কষ্ট না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় স্টল ও প্যাভিলিয়নের মাঝে পরিসর ফাঁকা রেখে সারিবদ্ধভাবে স্টল নির্মিত হবে।
ছোট কাগজের সম্ভার লিটল ম্যাগ চত্বর থাকবে মুক্ত মঞ্চের ডান পাশে। রমনা কালী মন্দিরের নিকটবর্তী মেলার অংশটুকু পরিণত হবে শিশুদের রাজ্যে। এই অংশে শিশুতোষ গ্রন্থের স্টলের পাশাপাশি থাকবে সোনামনিদের মন রাঙানো শিশু চত্বর। সিসিমপুরের আয়োজনটিও অনুষ্ঠিত হবে এই অংশে।
বইমেলার সার্বিক বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. সরকার আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই মেলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতি চলছে। আগামী পয়লা ফেব্রুয়ারি মেলা উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবারের মেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জুলাই শিক্ষার্থী গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। এই প্রেক্ষাপটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জাগরণের প্রভাব বা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে মেলায়।
মেলার অঙ্গসজ্জা থেকে সর্বত্র জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন ঘটবে। এছাড়া বইমেলা যেহেতু তারুণ্য ও মননশীলতার উৎসব তাই স্বাভাবিকভাবেই জুলাই জাগরণ প্রভাবিত করবে মেলাকে। সব মিলিয়ে আশা করছি এবার একটি চমৎকার বইমেলা হবে। মেলার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর ও শিশু চত্বরকে বিশেষভাবে সাজানো হবে। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রবেশদ্বারটির যথাযথ ব্যবহার ও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে সেটিকে সুন্দর করে সাজানো হবে।
প্যাভিলিয়ন নির্মাণের জটিলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকাশকদের পক্ষ থেকে আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা পূর্বের মতোই চারপাশ খোলা রেখে প্যাভিলিয়ন নির্মাণের আবেদন জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। শীঘ্রই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।