শীত নিবারণের চেষ্টা।
গরম কাপড়, হাত মোজা, কানটুপি—শীত নিবারণের চেষ্টা করছে নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষজন। তবুও যেন শীতকে হার মানানো যাচ্ছে না। শুধুমাত্র আগুনের তাপেই যেন মেলে শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বস্তি। ঘনকুয়াশা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, পাশাপাশি আজ শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) দিনভর দেখা মেলেনি সূর্য।
বরফের মতো ঠান্ডা শীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে উত্তরজনপদের শহর, বন্দর, গ্রাম ও নদীবেষ্টিত গ্রামগুলো। আশ্চর্য হলেও সত্য, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তাপাড়ে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য মাত্র তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস! এলাকাবাসী বলছেন, তিস্তাপাড় যেন বরফ ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। আজ শুক্রবার এ অঞ্চলে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যার পার্থক্য মাত্র তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শুক্রবার আবহাওয়া অফিসের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, নীলফামারীর ডিমলা আবহাওয়া অফিস সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ১৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে পার্থক্য দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সুত্রমতে, দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পাবনার বাঘাবাড়িতে ৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হলেও সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকায়, সেখানকার শীতের তুলনায় উত্তরাঞ্চলের রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। ফলে উত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া, শুধু ডিমলা নয়, উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পার্থক্য খুব কাছাকাছি ছিল শুক্রবার। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবারের তুলনায় গড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমেছে। আজ শুক্রবার রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ছিল ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস—পার্থক্য ৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দিনাজপুরে সর্বনিম্ন ১১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ১৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস—পার্থক্য ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, নীলফামারীর সৈয়দপুরে সর্বনিম্ন ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ১৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস—পার্থক্য ৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়ায় সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ১৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস—পার্থক্য ৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সর্বনিম্ন ১৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস—পার্থক্য ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ডিমলার তিস্তাপাড়ের টেপাখড়িবাড়ি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, "মাঘের শীতে যে বাঘ কাঁদে, এই প্রবাদটি আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। যে ঠান্ডা পড়েছে, আমরা বরফের মতো জমে যাচ্ছি। বাড়ির বাইরে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। হার মেনেছে শীতের পোশাক, আগুনের তাপেই স্বস্তি পাচ্ছি।" তিনি উল্লেখ করে বলেন, "২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি ডিমলা আবহাওয়া অফিস সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছিল ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন এত ঠান্ডা মনে হয়নি, আজকের মতো ঠান্ডা পড়েছে। আমার মতো বয়স্ক মানুষজন কঠিন দিন পার করছি।"
জেলার জলঢাকা উপজেলার কাঠালী গ্রামের বোরো চাষি মোকছেদ আলী (৫৫) জানান, "শুক্রবার ২ বিঘা জমির বোরো চারা রোপণ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এত ঠান্ডায় কেউ কাজ করতে আগ্রহী হয়নি। ফলে বোরোর চারা আজ রোপণ করা যায়নি।"
সবজি চাষি আজমির বলেন, "ভাই, খুবই ঠান্ডা। রাত-বিরাতে বরফের মতো লাগে। এত ঠান্ডায় কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। ভোরে পালং শাক, লাফা শাক ও লাউ শাক তুলতে এসেছি। কিন্তু শাক ধরতে পারছি না, বরফের মতো মনে হচ্ছে। হাত অবশ হয়ে আসে। কিন্তু কি করবো, টাটকা সবজি বাজারে নিতেই কাজ করতে হচ্ছে।"
অপর সবজি চাষি মোর্কারম হোসেন জানান, "দুপুরের দিকে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামে। তবে অল্প সময়ের এই বৃষ্টি ঠান্ডা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।"
নীলফামারীর রিকশাচালক রইস উদ্দিন জানান, "শুক্রবারের দিন ভাড়া ভালই পাওয়া যেত। কিন্তু আজ রাস্তাঘাটে মানুষ কম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভাড়া মারছি মাত্র দুইটা। এমন দুর্ভোগ আর সহ্য হয় না।"
ঘর-গৃহস্থালী এবং শিশু ছেলে-মেয়েদের রান্না করতে শীতে বেকায়দায় পড়েন গৃহিনীরা। তারা জানান, "ঘরের বিছানা, ফোরসহ আসবাবপত্র বরফ হয়ে যায়। ঘরে আনা পানিও বরফ হয়ে যায়।" এদিকে, শীতের কারণে বেড়েছে বিভিন্ন শীতজনিত রোগব্যাধি। শিশু ও বয়স্করা সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা শীতে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিচ্ছেন।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ লোকমান হাকিম জানিয়েছেন, "এমন অবস্থা থাকতে পারে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত। এরপর তাপমাত্রা বাড়তে পারে।"
সায়মা ইসলাম