সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের প্রকল্প ‘আমাদের বাড়ি’।।
‘কর্মহীন হয়ে গেছি, তাই এখন আমি পরিবারের বোঝা। চার সন্তান থাকলেও কেউ আমার খোঁজ নেয় না। আল্লাহর ইচ্ছায় বেঁচে আছি।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ গোলাম মোস্তফা দুলু। তিন বছর ধরে গোলাম মোস্তফার আশ্রয় ‘আমাদের বাড়ি’ নিবাসে। এখানে অপরিচিতদের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন গড়ে উঠেছে দুলু মিয়ার। পরিবারের যে বাইরে আছেন তা এখন আর মনেই হয় না তার। ‘আমাদের বাড়ি’র অনাথ শিশুদের আদর করেন নিজের নাতি-নাতনিদের মত। কোনো খরচ ছাড়াই থাকা, খাওয়া দাওয়া ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে সবকিছুই তিনি পাচ্ছেন। শুধু মোস্তফা দুলুই নয়, তার মত আরও অনেক অসহায় প্রবীণদের আশ্রয় ‘আমাদের বাড়ি’। প্রবীণদের পাশাপাশি এখানে পড়ালেখা সহ সকল সুবিধা নিয়ে আত্মিকবন্ধনে বেড়ে উঠছে হতদরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত ও অসহায় এতিম শিশুরাও।
চারিদিকে সবুজে ঘেরা, বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ, আর তারই মাঝে কোলাহলহীন পরিবেশে যশোরের নাটুয়াপাড়ায় বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নিঃসঙ্গ, অসহায় প্রবীণরা পার করছেন জীবনের শেষ মুর্হুতগুলো। আর তাদের সঙ্গে হতদরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত ও অসহায় এতিম শিশুরাও যেন খুঁজে পেয়েছে আপন ঠিকানা। 'আমাদের বাড়ি' তেমনই এক আবাসস্থল। আধুনিকার ছোঁয়ায় প্রবীণ ও এতিম শিশুদের জন্য গড়ে ওঠা আশ্রয় ‘আমাদের বাড়ি’, যা বাংলাদেশে প্রথম। আর এই মহান উদ্যোগের কান্ডারী মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ।
বয়স বাড়লে বৃদ্ধরা হয়ে যান শিশুর মত। তাদের এই শিশু সুলভ আচরণ পরিবারের অনেকেই নিতে পারেন না। আবার কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের প্রতি বাড়তে থাকে ছেলে মেয়েদের অবহেলা। যেখানে পরিবারের সেবা নিয়ে জীবনের বাকি সময়টা পার করার কথা, কিন্তু অনেকেরই সেটা হয়ে উঠে না। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত প্রবীণরা বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণরা সাধারণত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতা, একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার মতো নানা ভোগান্তির শিকার হন। শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকা শিশুরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে এবং আরও নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। কিন্তু ‘আমাদের বাড়ি’ অন্যান্য বৃদ্ধাশ্রম এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে আলাদা।
৫-১৮ বছরের অনাথ শিশুদের জন্য ‘আমাদের বাড়ি’তে সকল ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের বাড়িতে থেকে বিনা খরচে এইচএসসি পাস পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পাশাপাশি তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং কৃষি কাজে দক্ষ করে গড়ে তুলছে ‘আমাদের বাড়ি’। এছাড়া নিজের শরীর ফিট রাখার জন্য আধুনিক সব যন্ত্রপাতি দিয়ে গড়া হয়েছে ব্যায়ামাগার। পরিবেশ এবং মান সম্পর্কে আমাদের বাড়িতে বসবাস করা অসহায় ও এতিম শিশুরা জানায়, এখানে বসবাস করা প্রবীণদের সঙ্গে তাদের আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এখানের কর্মকর্তারা তাদের নিয়মিত খোঁজ রাখেন এবং পড়াশোনা করান। খাবার দাবার সহ কোনো কিছুতেই তাদের কষ্ট করতে হয় না।
এসব শিশুদের পড়াশোনার জন্য ‘আমাদের বাড়ি’র পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি মহিলা দাখিল মাদরাসা, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি টেকনিক্যাল কলেজ। যেখানে তারা এইচএসসি পর্যন্ত বিনা খরচেই পড়াশোনা করতে পারবে। এসব প্রতিষ্ঠানে আসে পাশের গ্রামের শিশুরাও পড়াশোনা করছে। শিক্ষার্থীরা যেন দূর দূরান্ত থেকে স্কুলে আসতে পারে সে জন্য শিক্ষার্থীদের প্রায় ২৫০০ সাইকেল উপহার দিয়েছেন ডা. এম এ রশিদ স্যার।
এদিকে, মাসিক স্বল্প কিছু দিয়েও স্বচ্ছল নিঃস্বঙ্গ বা একাকী প্রবীণদেরও থাকার সুযোগ রয়েছে এখানে। আমাদের বাড়িতে এক বছর চার মাস ধরে আছেন শিল্পী আক্তার (৭০)। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, পরিবারের মতো আচরণ পাওয়ায় এখানে তার খুবই ভালো লাগছে। তার দুই সন্তানের মধ্যে একজন কাতার এবং আরেকজন দুবাই থাকেন। আমাদের বাড়িতে প্রতিমাসে নাম মাত্র খরচ দিতে হয় শিল্পী আক্তারকে। একা বাড়িতে থাকতে পারেন বলে সন্তানরা এখানে রেখে গেছেন। সন্তানরা দেশে ফিরে বিয়ে করে সংসার গড়লে শিল্পী আক্তার ফিরে যাবেন।
আরেকজন হলেন আলতাফ হোসেন বকুল (৬৫)। মাসিক মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে আমাদের বাড়ি থাকছেন। তিনি জানান, আগে এক সময় তিনি ব্যবসা করতেন। কিন্তু মাফিয়াদের পাল্লায় পড়ে সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। আমাদের বাড়িতে থাকতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সবাইকে পরিবারের সদস্যর মতোই মনে হয় তার কাছে।
‘আমাদের বাড়ি’তে কর্মরতরা জানান, এখানে এক একটি কক্ষে থাকতে পারবেন একজন প্রবীণ ও একজন শিশু। সম্পর্কটা হবে নানা নাতি অথবা দাদা পোতা। নিজে বাড়িতে বাস করে যেমন সকলেই জীবন কাটিয়ে দেয় ঠিক তেমনিভাবে যারা অসচ্ছল বা সচ্ছল যাদের দেখা শোনার কেউ নেই তারা এখানে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, আত্ম কর্মসংস্থান ও শিক্ষ গ্রহণের সুযোগ পাবেন। সচ্ছলরাও তাদের আর্থিক সঙ্গতি অনুসারে কম মূল্যে পাবেন সেবাটি। এসব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যেও রয়েছে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। নিজস্ব বিদ্যৎ ব্যবস্থা, মিটিং রুম, হল রুম, ডরমেটরি ভবন, পানির ফোয়ারা, ডাইনিং, জিমনেসিয়াম, কুকার, অত্যাধুনিক লিফট, এম্বুলেন্স, নিজস্ব পরিবহন, স্টাফ কোয়ার্টার, পুকুর, কিচেন, বায়োগ্যাস প্লান্ট, সৌর বিদ্যুত ব্যবস্থা, ক্যাটল শেড প্রভৃতির সমাহার এই অজ পাড়াগাঁয়ে কল্পনাতীত।
এদিকে, ‘আমাদের বাড়ি’তে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, তাঁত মেশিন, সেলাই মেশিন, হাঁস, মুরগী, গবাদী পশু পালন, মাছ চাষ, ক্ষেত খামার ও সহজসাধ্য হাতের কাজ করে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করার বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে থাকা-খাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, আনুষ্ঠানিক, উপ-আনুষ্ঠানিক, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার সব সুযোগ। কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতি সপ্তাহে রোগী দেখেন ডা এম রশিদ। আর এসব রোগীদের থেকে নেওয়া নাম মাত্র ফি নিয়ে তা ব্যয় করেন ‘আমাদের বাড়ি’র জন্য।
মানব সেবায় এতো বড় মহৎ উদ্যোগের চিন্তা কিভাবে এলো জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এমনকী সারা পৃথিবীতে মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে যে প্রবীণ এবং শিশুরা অনেকটাই অবহেলিত। যেখানে ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে দেশে বিদেশে চলে যাচ্ছে বা অন্য কর্মসংস্থানের জন্য কোনও জায়গায় চলে গেছে, তখন দেখা যাচ্ছে প্রবীণ পিতা-মাতারা একাকী হয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে কথা বলার কেউ থাকে না। তাদের চিকিৎসা, মানসিক বিষয়গুলো দেখার কেউ থাকেনা। যেহেতু আমি দীর্ঘদিন মেডিক্যাল প্রফেশনে আছি, আমি বিষয়গুলো গভীরভাবে দেখেছি যে হাসপাতালে যখন প্রবীণরা আসে তারা স্বচ্ছল বা অস্বচ্ছল হোক তারা খুবই অসহায় অবস্থায় থাকে। তারা একেবারে অন্যের উপর নির্ভরশীল। এসব বিষয়গুলো দীর্ঘদিন আমাকে পীড়া দিতে থাকে। এরপর আমি চিন্তা করলাম যে একটা কনসেপ্ট দাড় করানো যায় কিনা।’
‘আমাদের বাড়ি’ নামকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতিম শিশুরা ও অসহায় হতদরিদ্র লোকগুলো যেন মনে না করে যে আমি এতিম বা অসহায়। এতিম বলা হলে মানসিকভাবে মানুষের মনের ভিতরে হৃদয়ের উপর একটা চাপ দেওয়া হয়। তখন ওই ব্যক্তি কিন্তু আর কখনও মানসিক ভাবে উৎকর্ষতা সাধন করতে পারে না বা আপগ্রেড হতে পারে না। এজন্য নামটা দিয়েছি, আমাদের বাড়িতে যে থাকবে সে অনুভব করবে এটা তার বাড়ি। এখানে প্রবীণ এবং শিশুরা সুন্দর একটা পারিবারিক বন্ধনে বসবাস করার মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।’
‘আমাদের বাড়ি’ কিভাবে পরিচালনা হয় এবং ব্যয়ভার বহনের বিষয়ে ডা. রশিদ বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রকল্পটি পরিচালনায় প্রতি মাসে সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ হয়। আমি আমার বেতনের টাকা এর পেছনেই ব্যয় করি। আমি আমার পৈত্রিক জমিও এই প্রকল্পে দিয়ে দিয়েছি। আর বাইরে থেকেও কেউ কেউ সাহায্য-সহযোগিতা করেন।’
তিনি বলেন, ‘সক্ষমদের জন্য এখানে কৃষিকাজ, বাগান করা, পোলট্রি, গরু-ছাগলের খামার, মাছচাষের মতো কাজে যুক্ত থাকার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে এখানে সকল ব্যবস্থা নেওয়া আছে। এখানে ডাক্তার, নার্স আছে এবং বেসিক প্যাথোলজি যে সব বিষয় রক্তপরীক্ষা করা, এক্সরে করা ও ইসিজি করার ব্যবস্থাও এখানে আছে। আর ঢাকায় থাকলেও আমরা প্রতিনিয়ত এখানে অনলাইনে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। এখানে দুই ক্যাটাগড়ির লোক থাকবে। যারা স্বচ্ছল তারা একটা যৌক্তিক পেমেন্ট এর ভিতরে থাকবে। আর যারা হতদরিদ্র অস্বচ্ছল তারা শতভাগ ফ্রি থাকতে পারবে। এখানে বয়স্করা সম্মানজনকভাবে জীবন ধারণ করতে পারবে।’
মানুষের কল্যাণে ডা. এম এ রশিদের অনন্য এক উদ্যোগ 'আমাদের বাড়ি' প্রকল্প। ২০২২ সালে যশোরের নাটুয়াপাড়ায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এক একর ১৫ শতক জমির উপর নির্মিত 'আমাদের বাড়ি'। চার তলাবিশিষ্ট আশ্রমটিতে একসঙ্গে বসবাস করতে পারেন ১৫০ জন। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ না থাকলে এমন কল্যাণমুখী ভাবনা এবং তার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’ গানটি যেন প্রকৃত প্রাণ ফিরে পাওয়ার একটি উদাহরণ ‘আমাদের বাড়ি’।