ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে সরিষা চাষ

বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হলদে ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হলদে ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ

সরিষার মাঠ পেরিয়ে ছুটে চলছে উত্তরাঞ্চলের ট্রেন

চিত্রশিল্পীরা ক্যানভাসে ছবি আঁকেন, আলোকচিত্রীরা ক্যামেরায় ছবি তোলেন। এই দুই শিল্পীদেরই ভীষণ পছন্দের ব্যাকগ্রাউন্ড হলো হলুদ সরষের খেত। ছবি তো ভবিষ্যতের স্মৃতির সঞ্চয়, এক বিশাল জীবন্ত ক্যানভ্যাস। সরিষা ফুলের ওই মিষ্টি সুবাস কি ছবির ভেতরে থাকে? না তাকে ধরা যায়? প্রাণভরে সেসব রূপ, সৌন্দর্য ও সুগন্ধকে উপভোগ করতে হয়, মৌমাছিদের গুনগুন গান শুনতে হয়, প্রজাপতিদের ডানা ঝাপটানো দেখতে হয়। 
বাহের দ্যাশের উত্তরজনপদের গ্রাম-বাংলার চারপাশ এখন সরিষা খেতে ঢাকা। কুয়াশায় মোড়ানো প্রকৃতি। চারদিকে বিরাজ করছে শীতের আবহ। মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে হলুদের বিশাল সমারোহ। যেদিকেই চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। প্রকৃতিতে চোখে সর্ষে ফুল দেখার সময় এখনই! নির্মল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সরিষা ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ।

বর্তমান সময়ে সরিষা খেতগুলোর কোনো কোনো জায়গায় মধুচাষিরা বসেন মধু সংগ্রহের জন্য। মাঘের ভরা শীতেও দূর থেকে হলুদ আভার আহ্বান। কুয়াশায় ধূসর প্রান্তর, তাও চারদিকে হলুদের সমাহার। মনে হয় যেন রূপকথার রাজকুমারীর গায়ে হলুদ। প্রজাপতি, মৌমাছি, হলুদিয়া-নীলরঙা পাখি, পোকামাকড় থেকে শুরু করে অনেককেই দেখা যায় এই রাজ্যে! সবাই যেন হুমড়ে পড়ে হলুদের ওপর।

আবার হলুদ এই ফসলের পাশ দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলে যায় ট্রেন। ট্রেন যাত্রীরা জানালা দিয়ে উপভোগ করে সর্ষের প্রকৃতি ও ঘ্রাণ। কোনো যাত্রী জানালা দিয়েই মোবাইলে ভিডিও ও ছবি তুলে নেন হলুদ আভা এই ফসলের মাঠের।
ফুসফুসের উপকার সাধিত হয় সরিষা ফুলের ঘ্রাণে। কৃষকরা ব্যস্ত সরিষার পরিচর্যায়, ভ্রমর মধু খুঁজে ফিরছে ফুলে ফুলে। দেখবেন নানা রঙের প্রজাপতিতে ভরে আছে সরিষা খেত। রঙ-বেরঙের প্রজাপতি ডানা ঝাপটানো চিত্তে জাগাবে নবতর আনন্দ। কোথাও ঝলক দিয়ে উঠছে কালো ডানায় হলুদ-লালের মিশ্রণ, নীল, সবুজ, লাল-নীলের ডোরাকাটা বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রজাপতিরা এখানে আসে বিশ্রাম নিতে। 
বুধবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি রবি মৌসুমে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় মোট ৭৮ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। গত বছর (২০২৪) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩ হাজার ১৬১ হেক্টর। কিন্তু আবাদ হয় এক লাখ এক হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। তবে ২০২২ সালে  সরিষা আবাদ হয়  ৫২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। সে হিসাবে সরিষা আবাদ কখনো বাড়ছে কখনো কমছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চাষিদের সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে গত বছর উত্তরাঞ্চলে ৩৪ হাজার কৃষককে দেওয়া হয়েছিল প্রণোদনা। প্রত্যেক কৃষক প্রণোদনা হিসেবে পায় এক কেজি বীজ ও ২০ কেজি সার। কৃষকরা বলছেন সরিষার প্রণোদনা কমে যাওয়ায় চলতি বছরে আবাদ কম হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের সরিষা আবাদের সফলতায় চলতি বছরে ৫ জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৯ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমিতে।

কিন্তু সেখানে কৃষকরা আবাদ করেছে মাত্র ৭৮ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১ হাজার ৫২৯ হেক্টর কম। এর মধ্যে রংপুর অঞ্চলের কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ সরিষা আবাদ করেছে কৃষকরা। এখানে ২৫ হাজার ৬৩৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। রংপুরে ২৫ হাজার ৪২০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১৬ হাজার ৫৫৪ হেক্টর, নীলফামারীতে ৮ হাজার ২৫৭ হেক্টর এবং লালমনিরহাটে ২ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে।

এ বছর সরিষা চাষে কৃষকদের  আগ্রহ কেন কমেছে, এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, আলু ও ভুট্টার আবাদ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া গত বছর আমন ধান রোপণে দেরি হওয়ার কারণে কৃষকরা আলু ও ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহী হয়েছেন। তারপরেও  প্রকৃতির দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দর। মাঠগুলো এখন সবুজ ও হলুদে ভরে উঠেছে। কৃষকরা সরিষার ভালো দাম আশা করছেন এবং খেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বর্তমানে যা আবাদ হয়েছে তাতে বাম্পার ফলন হবে।
নীলফামারী সদরের ইটাখোলার কৃষক ইউনুছ মিয়া জানান, তিনি এ বছর ৬৫ শতক জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়েছে। তিনি আশা করছেন, সরিষার দাম ভালো হলে তিনি লাভবান হবেন। জলঢাকা উপজেলার  কৃষক রমেন্দ্র চন্দ্র বলেন, শীতের তাপমাত্রা সরিষার ফলনে বড় ভূমিকা রাখে।

তবে এ বছর ফলন দেখে তিনি সন্তুষ্ট। তিনি মনে করছেন, সরিষা বিক্রি করে কিছুটা হলেও ফুলকপির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। ডিমলার কৃষক রশিদ আলী জানান, তারা এখন ভালো দামে সরিষা বিক্রির আশা করছেন। তারা বিশ্বাস করেন যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে, ভালো ফলন পাবেন। অনেক কৃষক জানায় সরিষা তুলে তারা সেই জমিতে বোরো ধান লাগাবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল বছর প্রতিমণ (৪০ কেজি) সরিষা বিক্রি হয় ১৬০০-২৩০০ টাকা দরে তবে ২০২২ সালে তা ছিল ৩,০০০-৩৪০০ টাকা। এ বছর সরিষার ভালো দাম আশা করছেন চাষিরা। 
জানা যায়, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয়ভাবে মাত্র ৩ লাখ টন তেল উৎপাদিত হয়, যা চাহিদার মাত্র ১২ শতাংশ। বাকি তেল আমদানি করতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরিষা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছে, যাতে দেশীয় তেল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সরিষা দেশের প্রধান ভোজ্যতেলের ফসল। সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। সরিষার তেলের নানা স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। খৈল মাছ ও গবাদি পশুর পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। এ ছাড়া সরিষাগাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কৃষি বিভাগের মতে দেশে তেলের চাহিদা মেটাতে সরিষার চাষ বৃদ্ধি জনকৃষকদের বলা হচ্ছে। কারণ অন্য ফসলের তুলনায় সরিষা চাষে কৃষকদের কম পরিশ্রম ও কম অর্থ খরচ করতে হয়। এ ছাড়া সরিষা চাষ জমির উর্বরতা শক্তিতে বৃদ্ধি করে আর পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে। কৃষকরা এ বছর সরিষা বিক্রি করে ন্যায্য দাম পেলে আগামীতে প্রণোদনা ছাড়াই তারা সরিষা চাষে আগ্রহী হবেন।

×