জীবিকার তাগিদেই নীলফামারীতে তিস্তাপাড়ের চর ও গ্রামে চলছে সেচনির্ভর বোরো আবাদ
চারদিন ধরে দেখা নেই সূর্যের। ঘন কুয়াশা ও উত্তুরে হিম বাতাস যেন মাটিকেও বরফ করে দিয়েছে। ঠান্ডা বরফের সেচে পানি হাত গুটিয়ে আসে। আঙ্গুল অসাড় হয়ে আসে। পাঁজরের হাড়ে ঠান্ডা কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তার পরও জমিতে বোরো ধানের চারা বুনছেন কৃষক। কুয়াশা আর কনকনে শীত চলছে নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাসহ উত্তরাঞ্চলে। কনকনে ঠান্ডায় জনজীবন প্রায় স্থবির।
কিন্তু মাঘ মাসের এমন শীত উপেক্ষা করে ফসলের মাঠে কৃষক কাজ করছে। থেমে নেই ফসলের মাঠে কৃষকের কাজ। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা. আত্রাই, করতোয়াসহ উত্তরাঞ্চলের নদনদী বিধৌত জনপদে কনকনে ঠান্ডায় মাঠে কীভাবে কাজ করছেন কৃষক এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। মূলত জীবিকার কাছে হার মানছে উত্তরাঞ্চলে কনকনে ঠান্ডা।
বুধবার নীলফামারীর ডিমলার তিস্তাপাড়ের চরখড়িবাড়ি এলাকার কৃষক গফুর খান (৫৫) বলেন, ‘হামরা যদি মাঠোত কাজ না করি ফসল ফলাইবে কায়। তোমরা গুলা খাবার পাইবেন কোনটে থাকি। জারোত কোকড়া নাগি ঘরোত শুতি থাইকলে কি আর ফসল হইবে।’
তিস্তার ঝাড়শিঙ্ঘেরশ্বর গ্রামের আছির উদ্দিন মাঝি (৬৫) ‘জার কি আর হামাক না নাগে। হামাকও জার নাগে। জারের ঠ্যালায় হাতপাও গুটি থুইয়া আইলসিয়া হয়া থাকলে হবে। সময় থাইকতে ফসল ফলাইতে হবে। তাক না হইলে ফলন ভালো পাওয়া যাবে না।’
একই গ্রামের কৃষক হারুন মাঝি (৫৮) কাজ করছেন মাঠে। বলেন, ‘জারোত কষ্ট করিয়া ধান লাগবার নাইকছি। এ্যালা যদি ধান না নাগাই তা হইলে অসময়ে ধান লাগাইলে ফলন ভালো হবার নয়।’ মনোবল ধরে রেখে কাজ করেন বলে জানান এই কৃষক। ‘বিয়ান থাকি বিকাল পর্যন্ত মাঠোত কাজ করি। জারের কারণে মাঝে মাঝে অ্যাকনা করি আগুন পোহাই। তাতে অ্যাকনা শান্তি পাওয়া যায়।’
একই ধরনের শীতের কথা বলেন কিসামত চরের ভুট্টার খেতে কাজ করা ৬৬ বছরের কৃষক সোলেমান খান, কৃষক ফজলার রহমান (৬৭) ও হোসনা বেগমসহ (৬২) অন্তত ১০-১২ জন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবার নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও গাইবান্ধা জেলায় ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। বোরো ধান বুননে কৃষক মাঠে নেমেছে। অনেকে আগাম বোরো ধান উৎপাদনে আগেভাগেই চারা বুনছেন। বুধবার পর্যন্ত রংপুর জেলায় এক হাজার ২২৫ হেক্টরে, কুড়িগ্রাম জেলায় ৪ হাজার ৯৬৫ হেক্টরে, গাইবান্ধা জেলায় ২৫ হাজার ৭৬০ হেক্টরে, নীলফামারী জেলায় ১ হাজার ১৬৮ হেক্টরে ও লালমনিরহাট জেলায় ৩৫৩ হেক্টরে বোরো চারা রোপন করা হয়, যা চলমান থাকবে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। সেচ নির্ভর বোরো আবাদে কৃষকরা তিস্তা সেচ, বরেন্দ্র সেচ, বিআরডিবির সেচ, নিজস্ব সেচ যন্ত্র ব্যবহার করছেন।
পঞ্চগড় ॥ তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও ঠান্ডার তীব্রতা যেন আগের চেয়ে বেড়েছে। অব্যাহত পাহাড়ি হিম বাতাসের ঠান্ডায় বিপাকে পড়েছে জেলার মানুষ। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে পথঘাট। দুদিন ধরে সূর্যের মুখ দেখা না দেওয়ায় অনুভূত হচ্ছে কনকনে শীত। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না কেউ। দিনের ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান কমায় বেড়েছে ঠান্ডার প্রকোপ। আকাশে মেঘ থাকার পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিম থেকে বয়ে আসা পাহাড়ি হিম বাতাসের তীব্রতা বাড়ায় অনুভূত হচ্ছে কনকনে শীত।
আবহাওয়া অফিস বলছে, বুধবার সকাল ৯টায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বিকেল ৩টায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইসঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১০০ শতাংশ।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে পথঘাট। কুয়াশার সাথে ঠান্ডার তীব্রতা বাড়ায় সকাল থেকে জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি অনেকটাই কম লক্ষ্য করা গেছে। আবহাওয়ার এই নাজুক পরিস্থিতিতে দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক ও রিক্সা-ভ্যানচালকসহ খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
এদিকে, শীতজনিত রোগে শিশু রোগীর চাপ বাড়ায় অনেকেই পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাপাতালের বারান্দার মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই হাসপাতালটিতে কয়েক দিন ধরে শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীর চাপ বেড়েছে।
বুধবার সকাল পর্যন্ত পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছেন ২১৪ জন।
কুড়িগ্রাম ॥ ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডায় অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের মানুষের জীবন যাত্রা। বুধবার জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এ অবস্থায় ঠান্ডা ও কুয়াশা উপেক্ষা করে কাজে বের হতে পারছেন না শ্রমজীবী মানুষ। সময়মতো কাজে বের হতে না পারায় বেকার বসে থাকছে হচ্ছে তাদের। গরম কাপড়ের অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ছিন্নমুল ও হতদরিদ্র মানুষ। জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। হাতপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আর এম ও ডা. শাহিদ সর্দার জানান, শীতের কারণে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ডায়রিয়া। তবে শীতজনিত রোগের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলে জানান তিনি।
টানা দুদিন থেকে সূর্য্যের মুখ দেখা যায়নি। মেঘলা আকাশে ঢাকা ছিল সমস্ত অঞ্চল। বিকেল হতেই হিমালয়ের বরফ ছোঁয়া কনকনে ঠান্ডা বাতাসে মানুষের দুর্ভেগ আরও বেড়ে যায়। চরম কষ্টে পরে নদ-নদী অববহিকার চর-দ্বীপচরের প্রায় ৭ লাখ মানুষ।
কুড়িগ্রাম কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের পর্যবেক্ষক সুবল চন্দ্র সরকার জানান, বুধবার জেলা সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গাইবান্ধা ॥ সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। কুয়াশার কারণে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখে চলাচল করতে দেখা গেছে। লোকজন খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল ৯টায় গাইবান্ধায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে ঘন কুয়াশার সঙ্গে কনকনে শীত ও হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
রংপুর আবহাওয়া অফিসে কর্মরত আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, যা কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে।