আল-আমিন
গরিবের ঘরে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন মো. নিজাম উদ্দিন হাওলাদার ও নাজমা বেগমের দম্পতি। আর তার সেই আলদিনের চেরাগ হচ্ছেন, তার মেঝ ছেলে আল-আমিন । তিনি এ বছর মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৮৬ দশমিক ২৫স্কোর করে মেধা তালিকায় ১১৭তম স্থান অধিকার করেছেন। ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আর এই খুশিতে দিশেহারা হয়ে অভাবি এই পরিবারের সবাই। কখনো রিকসা চালিয়ে আবার কখনো ভাত বিক্রি করে ছেলের পড়া লেখার খরচ যুগিয়েছেন তার বাবা নিজাম উদ্দিন। ছেলের এই বিরাট সাফল্য তার কাছে যেন আলাদিনের চেরাগ পাওয়ারমত ঘটনা ঘটেছে। তবে ছেলের ডাক্তারী পড়াশুনার খরচ তিনি কি ভাবে চালাবেন তা নিয়ে দুঃচিন্তায় পরেছেন।
নিজাম উদ্দিন হাওলাদার বলেন,আল-আমিনের পড়ালেখার খরচ যোগাতে অনেক কষ্ট করেছি। ও ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছি । তাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি, তিনি আমার কষ্টের প্রতিদান দিয়েছেন। আমার ছেলে ডাক্তার হবে। মানুষের চিকিৎসা করবে, এর চেয়ে বড় আর পাওয়া কি হতে পারে ? একপর্যায়ে তিনি আনন্দ ও অশ্রু ঝরা কণ্ঠে বলেন, গরিবের ঘরে আমি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছি। আর আর সেই আলাদিনের চেরাগ হচ্ছেন আমার ছেলে আল-আমিন। তবে ছেলের ডাক্তারী পড়াশুনার খরচ তিনি কি ভাবে চালাবেন তা নিয়ে দুঃচিন্তায় পরেছেন।
আল-আমিন পড়ালেখার পাশাপাশি তার বাবার ভাতের হোটেলেও সময় দিত। তার বাবার সাথে ভাত বিক্রির পাশাপাশি সিঙ্গারা ও সামুসা বানিয়ে বিক্রি করতো। আল-আমিনের বাড়ি বাউফলের নওমালা গ্রামে। তিনি মাধবপুর নিশিকান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২০ এসএসসি এবং ২০২২ সালে বরিশাল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন। অর্থের অভাবে নিয়মিত পড়ালেখা করতে পারেননি তিনি। তাই প্রায় এক বছর গ্রামের বাড়িতে থেকে বাবার সঙ্গে হোটেলে কাজ করেছেন । পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস করেছেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন।
আল-আমিনের বাবা নিজাম উদ্দিন হাওলাদারের বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাড়িরর কাছে একটি বাজারে ভাড়া ঘরে খাবার হোটেলের ব্যবসা করেন। পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিকাজ ও গবাদি পশু পালন করেন। তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম একজন গৃহিণী। এই দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আল আমিন দ্বিতীয়। তার মেডিকেলে ভর্তির খবর শুনে স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই ফুল নিয়ে বাড়িতে এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। মিস্টি মুখ করাচ্ছেন।
আল-আমিনের মা নাজমা বেগম বলেন , আল আমিন ছোট বেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের কথা শুনতো যেটা বলতাম ওইটা করতো । আল-আমিন লেখাপড়া করেছে অনেক কষ্ট নিয়ে । বাবার সঙ্গে দোকানে কাজ করেছে , আবার স্কুলেও গিয়েছে । আমি ঠিকমত ওকে খাবার দিতে পারিনি । আমি চাই আমার ছেলে ডাক্তার হয়ে গ্রামের সবার সেবা করুক । অনেকে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারেনা তাদের বিনা টাকায় চিকিৎসা করবেন।
আল-আমিন বলেন, আমার এই সফলতার পেছনে মূল সাহস ও অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে আমার পরিবার। বিশেষ করে আমার বাবা মা । তারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল থাকার পরেও আমার লেখাপড়ার খরচ সঠিকভাবে চালিয়েছে । তারা অনেক বাধার সম্মুখীন হওয়ার সত্ত্বেও আমার প্রতি কখনো কোনো অযত্ন করেনি । তিনি আরও বলেন,বাংলাদেশে যে মেডিকেল সেক্টর রয়েছে সেখানে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে বিরাট বৈষম্য রয়েছে। আমি চাই এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে । সবাইকে সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া এবং সঠিক চিকিৎসা দেওয়া আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ।
আল আমিন বলেন,আমরা চার ভাই-বোন সবাই লেখাপড়া করি। সুতরাং সেখানে খরচ আছে । আমার বাবা দোকানের পাশাপাশি কৃষিকাজ করেন।বাবা কৃষিকাজে মাঠে থাকালে আমিই দোকান পরিচালনা করতাম। যাতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়। বাবার যেভাবে সহযোগিতা দরকার ছিলো আমি সেভাবেই সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। বাবার কাজকে কখনো আমি ছোট করে দেখিনি । আমার কখনো মনে হয়নি এটা কেনো করছি কারণ এটা আমার দায়িত্ব । বাবা মা তো সন্তানের জন্যই করে ,আমারও দায়িত্ব বাবা মার কাজে সাহায্য করা ।
ইউসুফ সেন্টু নামের এক সংবাদ কর্মী বলেন, অভাবের সংসারে আল-আমিন বরিশালে থেকে পড়াশুনা করতে না পারলেও বাড়িতে থেকে অনলাইনে ক্লাস করেছে । এ রকম ভদ্র ও বিনয়ী স্বভাবের ভালো ছেলে বর্তমানে পাওয়া মুশকিল। ওর মধ্যে হিংসা ও অহংকার নেই। তার এমন ভালো ফলাফলে শুধু তার বাবা ও মা নয়, গোটা এলাকার মানুষ আনন্দিত ও গর্বিত।
মাধবপুর নিশি কান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়দেব চন্দ্র শিকারী বলেন,আমাদের বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আল আমিনকে অভিনন্দন জানিয়েছি । আমরা গর্বিত আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্র আল-আমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে । স্কুল জীবন থেকেই দেখতাম আল-আমিন লেখাপড়ায় অনেক মনোযোগী । ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পাঠদান শুনতো। আর্থিক অভাবের কারণে আল-আমিনের লেখাপড়ায় একটু ব্যাঘাত ঘটেছে । আমি প্রার্থনা করি আল আমিন যেন ভালো একজন ডাক্তার হয়ে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে ।
ইসরাত