.
অতিথি পাখির গ্রাম হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও এখন সেই গ্রামে পাখিশূন্য অবস্থা। এক সময় হাজারো পাখির কলতানে মুখরিত থাকত যে গ্রাম, এখন সেই গ্রাম অনেকটাই নিস্তব্ধ। কয়েক বছরের ব্যবধানে কমে গেছে অতিথি পাখির বিচরণ। কিছু বক-পক্ষীর ওড়াউড়ি থাকলেও সকাল-সন্ধ্যায় সেই কলকাকলি আর নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে পাখির কলতানে ভরা গ্রামের ইতিহাস এখন অতীত গল্প হতে চলেছে।
বলছিলাম, রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের পচামাড়িয়া গ্রামের কথা। কয়েক বছর আগেও এ গ্রামে আসলে চোখে পড়ত হাজারো পাখির ওড়াউড়ি, শোনা যেত কলতান। পাখিদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠায় এ গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এ গ্রামের সেই বাঁশবাগান, গাছপালা সবই আছে এখনো। তবে একেবারেই কমে গেছে পাখির বিচরণ। পাখি নেই বললেই চলে।
রবিবার সরেজমিনে দেখা যায়, পাখির উড়াউড়ি নেই বললেই চলে। পরিবেশও অনেকটাই নিস্তব্ধ। কয়েক বছর আগে যেখানে সারাক্ষণ পাখিদের ওড়াউড়ি চোখে পড়ত। এখন তার কিছুই চোখে পড়েনি। স্থানীয়রা জানান, এখন আর পাখি নেই। কয়েক বছর ধরে অতিথি পাখি আসে না। স্থানীয় কিছু বক-পক্ষী থাকলেও সংখ্যায় কম। সকাল-সন্ধ্যায় পাখির কলতানে আর মুখরিত হয় না ‘পাখিগ্রাম’। পাখিমেলাও বসে না। পাখিপ্রেমীদের আনাগোনাও নেই এ গ্রামে।
গাছে গাছে পাখি দেখার জন্য এ গ্রামে সুউচ্চ একটি টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে উঠলে সহজেই দেখা যেত পাখির দল, ওড়াউড়ি। এখনো সেই টাওয়ার আছে। তবে আর পাখিপ্রেমীদের জন্য সেটি ব্যবহৃত হয় না। কারণ একটাই-পাখি নেই। কিন্তু কেন? এর কোনো সদুত্তর মেলেনি।
রাজশাহী থেকে ৩২ কিলোমিটারের পথ পুঠিয়া। সেখান থেকে তাহেরপুর মোড় থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে পচামাড়িয়া বাজার। সেখানেই পাখিদের আবাস। রবিবার সেই গ্রামে গিয়ে অতিথি পাখি চোখে পড়েনি।
স্থানীয়রা জানায়, শীতের শেষভাগে এই গ্রামে কয়েক বছর আগেও অতিথি পাখিরা আসত ঝাঁকে-ঝাঁকে। ২০০৪ সালের পর কয়েক বছর ধরে অতিথি পাখির ভালোবাসায় গ্রামবাসীরা এই গ্রামকে বানিয়েছিল অতিথি পাখির অভয়ারণ্য। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পাখিপ্রেমী মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠত গ্রামটি। সারাদিন পাখিরা এলাকার বিভিন্ন খালে, বিলে-ঝিলে আহার করে সন্ধ্যায় ফিরে আসত এই গ্রামে। আশ্রয় নিত শিমুল, বাঁশ, কড়ই ও আম গাছের ডালে ডালে। এই গ্রামের পাখিপ্রেমী মানুষ আর পাখিদের ঘিরে আয়োজন হতো পাখি মেলার। সারাদেশের পাখিপ্রেমীরা এখানে আসতেন। হরেক পাখির সঙ্গে পরিচিত হতেন। আর পাখির কলতানে মুগ্ধ হতেন। তবে কয়েক বছর ধরে আর এসবের বালাই নেই। পাখিপ্রেমীরাও এখন এ গ্রামবিমুখ।
স্থানীয়রা জানান, সারাবছরই এখানে পাখি থাকত। অতিথি পাখিরা গাছে গাছে নিজস্ব আবাস গড়ে তুলেছিল। আর শীতের সময় পাখির সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত। এখানে স্ন্যাক বার্ড (সাপপাখি), দুই প্রকারের ছোট মাথা এবং বড় মাথার ওপেন বিল স্টক (শামুক খল), তিন প্রকারের ছোট, বড় এবং মাঝারি পানকৌড়িসহ নানা ধরনের পাখির দেখা মিলত। আর দেশী প্রজাতির বক, ঘুঘু, চড়ুই, চখাচখিসহ হরেক পাখি থাকত মিলেমিশে।
স্থানীয়দের মধ্যে এই পচামাড়িয়া ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ‘পাখির গ্রাম’। এখানে সারাবছর বিভিন্ন প্রকার দেশী ও অতিথি পাখির আনাগোনা চোখে পড়ত। বহুদিন থেকে পচামাড়িয়া গ্রামের বাঁশঝাড়গুলোতে পাখি বাস করত। বারনই নদীর অববাহিকায় বছরের অনেকটা সময় জলাবদ্ধতা থাকে খাল-বিলে। এইসব বিলের কিনারে গ্রামগুলোতে মানুষের বসবাস। ফুল, ফল, ফসলে ও গাছ-গাছালিতে ভরপুর, সুন্দর, মনোরম এলাকা হওয়ায় ও খাল-বিলের আধিক্য থাকায় শীত মৌসুমে আসত অতিথি পাখি।
সরেজমিনে পাখিপ্রেমীদের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেকদিন থেকে পচামাড়িয়াতে পাখি বসবাস করলেও সংরক্ষণ শুরু হয় মূলত ২০০৪ সালে প্রথমে। গ্রামের কিছু যুবক এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে। পরে তারা সহযোগিতার জন্য তৎকালীন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুলের স্মরণাপন্ন হন। বিষয়টি আমলে নিয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান পাখি সংরক্ষণে ব্রত হন। ওই গ্রামে ও আশেপাশের এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাখি মারা নিষিদ্ধ করে দেন।
তখন থেকেই পর্যায়ক্রমে গ্রামের মানুষসহ এলাকার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিষয়টি। বিভিন্ন মিটিং, সমাবেশ, স্টলে আলোচনায় মাইকিং করে পাখি মারতে নিষেধ করা হয় মানুষকে। এক বছরের মধ্যে পচামাড়িয়াতে ২০০৫ সালে পাখির সংখ্যা অনেকটা অলৌকিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে প্রথম থেকে শুরু হয় আরও অনেক উদ্যমে পাখি সংরক্ষণের কাজ।
সে সময় এলাকাবাসীকে নিয়ে গঠন করা হয় পাখি সংরক্ষণ কার্যকরী কমিটি (এখন এ কমিটির অস্তিত্ব মেলেনি)। কমিটির উদ্দেশ্য ছিল পাখি সংরক্ষণে এলাকার সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করা। পাখি রক্ষায় সেই সময়ে ব্যাপকভাবে মাইকিং করা হয়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে টাঙ্গানো হয় সাইনবোর্ড, ব্যানার। সে সময়ে ব্যাপক পরিচিতি পায় গ্রামটি। এ নিয়ে সেই সময়ে জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে এ চিত্র প্রচার হওয়ার পর দেশ-বিদেশের বহু পাখিপ্রেমী ছুটে আসেন এ গ্রামে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন বিদেশী পর্যটকসহ শিক্ষক, ছাত্র, পাখিপ্রেমী সর্বস্তরের মানুষের আগমন ঘটে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রতি বছর নভেম্বর থেকে পাখি আসা আরম্ভ হতো আর থাকত মার্চ পর্যন্ত। তবে বেশি পাখি দেখা যেত ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে। এ ছাড়া সারা বছর এখানে পাখি থাকত, অনেক পাখি বাসাও বেঁধেছিল। শামুক খল, বিভিন্ন প্রজাতির পানকৌড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির বক, বিরল প্রজাতির উদই গয়ারসহ বহু প্রজাতির পাখির দেখা মিলত।
তবে এখন চিত্র ভিন্ন। ওই পাখির আবাসস্থল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা প্রশান্ত কুন্ডু জানালেন, এখন আর পাখির কলতান নেই। নেই ওড়াউড়ি। সকালে আর পাখির ডাক ঘুম ভাঙাতে পারে না। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আওয়াজ কানে বিঁধে না। তিনি বলেন, প্রায় সাত-আট বছর থেকে পাখি কমতে শুরু করে। এখন কিছুটা পাখি রয়েছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম মোল্লা বলেন, এ গ্রামে পাখিদের সেই দৃশ্য এখন অতীত হতে চলেছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় পাখির ঠিকানা গড়ে ওঠায় ও বড় বড় গাছপালা কেটে ফেলায় পাখিরা বিমুখ হয়েছে। যেসব গাছ ও বাঁশঝাড়ে পাখিরা থাকত তা অনেকাংশে সাবাড় করা হয়েছে। এ ছাড়া এলাকার খাল-বিল, জলাশয় কেটে পুকুর খনন করে বাণিজ্যিক মাছের চাষ করা হচ্ছে। পাখিরা আর আহারের খোঁজে খাল-বিল না পেয়ে ক্রমেই কমে গেছে। তিনি বলেন, ফসলের মাঠসহ সবখানে অবাধ কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পাখিদের আহার না থাকাও একটি কারণ। তিনি বলেন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, অতিবৃষ্টি, টানা খরা বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও পাখিরা টিকতে না পেরে কমে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মাইনুল ইসলাম জানান, পচামাড়িয়ায় পাখি সংরক্ষণে এলাকাবাসী সচেষ্ট থাকলেও এখন প্রধান সমস্যা পাখি যে সকল শিমুল গাছ, বাঁশঝাড় ও অন্যান্য গাছে থাকে তার সবগুলো ব্যক্তিমালিকানা জমির ওপর। তাই অনেক সময় মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে গাছ ও বাঁশ কাটছে, এতে পাখি থাকার আবাসস্থল কমে গেছে।
তার মতে, পাখি সংরক্ষণসহ এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। না হলে এ গ্রামের ‘পাখি ঐতিহ্য’ চির অতীত হয়ে যাবে।