ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায়

উখিয়া-টেকনাফে মানব পাচার চক্র সক্রিয়

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ও নিজস্ব সংবাদদাতা, উখিয়া

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২১:০৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

উখিয়া-টেকনাফে মানব পাচার চক্র সক্রিয়

উখিয়া-টেকনাফে মানব পাচার চক্র

উখিয়া-টেকনাফে অপহরণের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অপহরণ আতঙ্ক যেন এখানকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। কখনো শিশু, কখনো যুবক, কখনো বৃদ্ধা, সরকারি বনকর্মী থেকে শুরু করে বাদ যাচ্ছে না কেউ। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অপহরণের শিকার হলেই দিতে হয় মুক্তিপণ। মুক্তিপণ না পাওয়া গেলে অনেক সময় অপহৃত ব্যক্তির ভাগ্যে নেমে আসে নিশ্চিত মৃত্যু। টেকনাফে প্রতিদিনই ঘটে চলেছে অপহরণ বাণিজ্য। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষদের বিভিন্ন ব্যানারে মানববন্ধন করতে দেখা গেছে। তারপরও এই অপহরণ বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না। এই অপহরণ চক্রে জড়িত রয়েছে নতুন পুরনো বিশাল মানব পাচারকারী সিন্ডিকেট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে এই অপহরণ কারবার। সম্প্রতি আলোচিত মোহাম্মদ আরাকান (৬) নামে শিশুটি অপহরণ হওয়া ও মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার হলেও তাকে মাটিতে পুঁতে রাখার ভিডিও দৃশ্যটি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এ ঘটনা যেতে না যেতেই উখিয়া রত্নাপালং ইউনিয়নের জসিম (২০) নামে আরেক যুবক অপহরণের শিকার হয়েছে। জসিম উদ্দিন রত্নাপালং ৪ নং ওয়ার্ডের আলীর ছেলে। জসিমের মা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে কাজের সন্ধানে গত ১০ জানুয়ারি শুক্রবার বাড়ি থেকে বের হয়েছিল তার ছেলে। সঙ্গে ছিল একই এলাকার বাহাদুরের ছেলে রিদুয়ান আকাশ নামে আরেক যুবক। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও ছেলের খোঁজ না পেয়ে পরিবার জসিমকে খোঁজাখুঁজি করলে বাহাদুরের শালী মোহসেনা আকতারের কাছে শুনতে পায় জসিম অপহরণ হয়েছে। মুক্তিপণ দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হবে। মোহসেনা নামে ওই মহিলার মাধ্যমে বাহাদুর জসিমের পরিবার থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। ১ দিন পরে তারা টাকা নিয়ে গেলে জবাব দেয় জসিম এখন তাদের হাতে নেই অন্য পাচারকারীরা তাকে নিয়ে গেছে। এই সূত্র ধরে মোহসেনা নামে ওই নারীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ১১ জানুয়ারি তারিখে জসিমের সঙ্গে বাহাদুরের ছেলেসহ আরও ৫ জন অপহরণ হয়। জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে দিলে অপহরণকারীরা সবাইকে ছেড়ে দেবে বলেছিল তার বোনের জামাই বাহাদুরকে। তারা সবার চিন্তা না করে শাপলাপুর এক চৌকিদারের আশ্বাসে তাদের ছেলে রিদুয়ানকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। বাকিরা অপহরণকারীদের কাছে আটকে থেকে যায়। রিদুয়ানের দেওয়া তথ্যমতে, এসব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অপহরণ চক্র ও মানব পাচারকারীদের শনাক্ত করে ওই মহিলা নিজেই বাদী হয়ে তাদের নাম উল্লেখ করে উখিয়া এবং টেকনাফ থানায় লিখিত পৃথক অভিযোগ দেন বলে জানান মহসেনা।
বাহাদুর নামে ওই যুবকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে এ ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রত্নাপালং তুলাতুলী এলাকার ইমরান প্রকাশ বাচ্চু নামে এক ছেলের ফাঁদে পড়ে আমার ছেলে রিদুয়ান, জসিমসহ ৫ জন ছেলে ইনানীতে বেড়াতে যায়। সেখান থেকে ইমরান প্রকাশ বাচ্চু নামে ওই ছেলেটি আমার ছেলে রিদুয়ান, জসিমসহ তারা ৫ জনকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে শাহা আলম নামে এক মানব পাচারকারীর হাতে তুলে দেয়। সেই মানব পাচারকারী শাহ আলম তারা ৫ জনকে শাপলাপুরের কেফায়েত নামে আরেক মানব পাচারকারী ও অপহরণ চক্রে জড়িত ব্যক্তির কাছে তুলে দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। অনেক কষ্ট করে শাপলাপুর ৮ নং ওয়ার্ডের চৌকিদার ও মেম্বারের সহযোগিতায় আমার ছেলে রিদুয়ানকে মুক্তিপণ ছাড়া সহি সালামতে উদ্ধার করি। বাকি ৪ জন এখনো উদ্ধার হয়নি।  
পাঁচজনের মধ্যে একজনকে কিভাবে উদ্ধার করা হলো এমন রহস্যজনক তথ্য জানতে রিদুয়ানকে উদ্ধারকারী শাপলাপুর ৮ নং ওয়ার্ডের গ্রামপুলিশ (চৌকিদার) শহিদুল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে জানান, রিদুয়ান নামে একজনকে শাপলাপুর এক বাড়ি থেকেই পাওয়া গেছে। মানব পাচারকারীদের হাতে অপহরণ হওয়া তারা ৫ জনের মধ্যে রিদুয়ান নামে ছেলেটি বুদ্ধিমান ছিল। সে ওই গ্রুপ থেকে কৌশলে এক স্থানীয়র বাড়িতে পালিয়ে আসে। সেখান থেকে বাড়িওলা মেম্বারের কাছে তুলে দেয় ওই ছেলেকে। পরবর্তী মেম্বার ওই ছেলেকে আমার জিম্মায় দিয়ে পরিবারের কাছে নিরাপদে তুলে দিতে বলেন। এর পর অপহরণকারী ও মানব পাচারকারী কেফায়েত নামে এক লোক আমার থেকে ওই ছেলেকে ছিনিয়ে নিতে বিভিন্ন অপচেষ্টা চালায়। আমাকে অনেক হুমকি-ধমকিও দিয়েছিল। তারপরও আমি পরিবারের হাতে রিদুয়ান নামে ওই ছেলেকে তুলে দিয়েছি।
অভিযোগ রয়েছে, উখিয়া রত্নাপালং ইউনিয়নের ইমরান প্রকাশ বাচ্চু (২৪), জালিয়াপালং ইউনিয়নের শাহ আলম (৩২), টেকনাফ শাপলাপুর এলাকার কেফায়েতসহ তারা ১০/১১ জনের একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
এদিকে রিদুয়ান ও তার পিতা বাহাদুর, মোহসেনাসহ রিদুয়ানকে উদ্ধার করা সকল ব্যক্তিও এই অপহরণ ও মানব পাচার চক্রে জড়িত বলে অপহরণ হওয়া ৪ জনের পরিবার মন্তব্য করেন। তাদের দাবি ৫ জনের মধ্যে একজন মুক্তিপণ ছাড়া আসতে পারলে বাকি ৪ জন কেন আসল না? রিদুয়ানসহ তার আত্মীয়-স্বজনরাও এই কাজে জড়িত। প্রশাসনের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনতে জোর দাবি জানান তারা।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিরাই অপহরণ বাণিজ্যের মিশনে কাজ করছে। চক্রে জড়িতরা কখনো মানবপাচার কখনো অপহরণকারী হয়ে উখিয়া-টেকনাফে অরাজকতা সৃষ্টি করে আসছে। অল্প খরচে সহজ উপায়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যুবকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আরিফ হোসেন বলেন, উখিয়াতে গত ১ মাসের ভেতরে কোনো অপহরণের ঘটনা ঘটেনি। তবে এ কাজে জড়িত কাউকে পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ গিয়াস উদ্দিন বলেন, লিখিত ভাবে অভিযোগের বিষয়টি আমি অবগত নই। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাউকে উদ্ধার করা হয়েছে কি না সেটাও আমার জানা নেই। তবে এখানে এরকম ঘটনা সবসময় ঘটছে। অভিযোগকারীদের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে পুলিশ ভিকটিমদের উদ্ধারে কাজ করবে।

×