ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা

কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙন রোধ, ২১ বছর ধরে ঝুলে আছে প্রকল্প

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া

প্রকাশিত: ০০:৪৩, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০৩:২৩, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙন রোধ, ২১ বছর ধরে ঝুলে আছে প্রকল্প

ছবি : সংগৃহীত

সাগরের অব্যাহত ভাঙ্গনের কবল থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গনরোধে স্থায়ী প্রতিরক্ষায় দুই যুগ ধরে সৈকত এলাকার সমীক্ষা শেষে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ শুধু প্রকল্প প্রনয়ণ ও প্রস্তাবনার কাজ চলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ একাধিকবার ডিপিপি তৈরি করে প্রস্তাবনা আকারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে এসব খবর গণমাধ্যমকে জানানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। শুধুমাত্র প্রতিবছর জরুরি প্রটেকশনের নামে সৈকতের শুন্য পয়েন্টের দুইদিকে তিন-সাড়ে তিন শ’ মিটার এলাকায় জিও টিউব ও জিও ব্যাগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। যা নিয়ে পর্যটকের ক্ষোভ রয়েছে। হচ্ছে তাদের ভোগান্তি। ক্ষোভ রয়েছে কুয়াকাটার স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বিনিয়োগকারীদের। 

সর্বশেষ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০২৩ সালে ‘কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকতের ভাঙ্গনপ্রবণ প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৭৫৯ কোটি ৫৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে। এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- সমুদ্র তীর প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ৬৮টি গ্রোয়েণ নির্মাণ, ট্যুরিজম পার্ক, মসজিদ-মন্দির এলাকার প্রতিরক্ষায় ৬০০ মিটার এলাকায় কাজ। এছাড়া দুই কিলোমিটার ৭০০ মিটার সি-বীচের শিপিং ডিফেন্স নির্মাণ করে প্রতিরক্ষা করা।

কলাপাড়াস্থ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে আরও জানানো হয়, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙ্গনরোধ হবে। কিন্তু এ প্রকল্পটির আজ অবধি চুড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি। অনুমোদন না হওয়ায় সৈকত প্রতিরক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ কবে কার্যত বাস্তবায়ন হবে তা অনিশ্চয়তায় রয়েছে।

এর আগে ২০১৮ সালে সম্পুর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২১২ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করে সৈকতের শুন্য পয়েন্টের দুই দিকে পাঁচ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেখানে পরিকল্পনা ছিল গ্রীন সী ওয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে শোরলাইন বরাবর স্থীর থাকবে। সৈকতের দেশভাগে গ্রীন সী ওয়ালের ওপর দিয়ে পর্যটকরা হাঁটাচলা করতে পারবেন। সী ওয়ালের ওপর ঘাস জন্মাবে। এটি হবে পরিবেশবান্ধব, হবে দৃষ্টিনন্দন। পর্যটক-দর্শনার্থীরা পাবে সী ওয়ালে বসে সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ। সী ওয়ালটি অবস্থান ভেদে ২১ মিটার প্রস্থ এবং দুই-আড়াই মিটার উচু হবে। গ্রীন সী ওয়ালের সামনের দিকে উত্তাল ঢেউয়ের তান্ডব ঠেকাতে নির্দিষ্ট এলাইনমেন্ট বরাবর সাগরের অন্তত তিন মিটার গভীর তলদেশে জিও টিউব বসানো হবে। যার ফলে পলি জমে বীচের পরিধি আরও বাড়বে, প্রশস্ত হবে। জিওটিউবটি এমনভাবে বসানো হবে যে জোয়ারের সময় এটি পানির নিচে থাকবে। দৃশ্যমান হবে না। ফলে পর্যটকের দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে না। জিও টিউবের ওপর দিয়ে সহজেই নৌকাসহ জলযান সাগর অভ্যন্তর থেকে বেলাভূমে ভিড়তে পারবে।

সৈকতের ভাঙ্গন রোধে এবং পূর্বের প্রশস্ততা ফিরে আনার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এভাবে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার একের পর এক প্রকল্প পরিকল্পনা আর সমীক্ষায় থেমে যায়। বর্তমানে সৈকতের চরম বেহালদশা। শুধুমাত্র তিন শ’ মিটার নিয়েই জিও টিউব আর জিও ব্যাগের জরুরি প্রটেকশনের মধ্যে আটকে আছে। এসব জিও টিউব আর ব্যাগের বালু অনেকটা বের হয়ে গেছে। শ্যাওলা ধরে গেছে। প্রতিনিয়ত পর্যটক পা পিছলে পড়ে আহত হচ্ছে। এমনকি বিবর্ণ এসব টিউব ও ব্যাগ অপসারণের দাবি করছেন পর্যটক ও স্থানীয় মানুষ। তাদের দাবি, এতে সৈকত শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিক ক্যামেরাম্যান সোহেল জানান, এই জিও ব্যাগ পর্যটকের হাটাচলার জন্য বিপজ্জনক।

সূত্র মতে জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের ১৭ দশমিক ২৫০ তম কিলোমিটার থেকে ৩৭ দশমিক ২৫০ তম কিমি পর্যন্ত বেড়িবাঁধের বাইরের দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার মূলত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকা নির্ধারণ করা রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গামিত লেকের ২৪ দশমিক ২৫০ তম কিমি থেকে আন্ধারমানিক নদী মোহনার ৩৪ দশমিক ৭৫০ তম কিমি পর্যন্ত সাড়ে দশ কিলোমিটার সৈকত সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। যেখানে মূলত পর্যটকরা বিচরণ করেন। এই সাড়ে দশ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ দশমিক ৪০০ কিলোমিটার থেকে ৩২ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচ দশমিক এক কিলোমিটার সাগরের তীব্র ভাঙ্গন এলাকা। বর্তমানে সৈকতে ঝুকিপুর্ণ পাঁচ কিলোমিটার অংশের মধ্যে আড়াই কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপুর্ণ। যা রক্ষায় গেল বছর জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হয় প্রায় দুই কিমি অংশে। তখন জিও টেক্সটাইল ব্যাগ দেয়ার পাশাপাশি জিও টিউব দেয়া হয়। কিন্তু এখন টিউব ও ব্যাগের বেহাল দশা। ঢেউয়ের তীব্রতায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বেলাভূমে চলছে তীব্র ভাঙ্গন।

পর্যটকসহ সাধারণ মানুষ ও কুয়াকাটার বিনিয়োগকারীরা জানান, গোটা সৈকত রক্ষায় সাগরের তীব্র ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া না হলে কুয়াকাটার দীর্ঘ সৈকত সাগরগর্ভে দ্রত বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও থাকছে চরম ঝুঁকিতে। আর কবে নাগাদ মূলত স্থায়ী প্রটেকশনের প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হবে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ কেউ নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি। বর্তমানে কুয়াকাটার লগ্নিকারকরা একারণে অনেকটা হতাশাব্যক্ত করেন।

কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, কুয়াকাটার এখন মূল সমস্যা সৈকতের স্থায়ী প্রটেকশন দেওয়ার বিষয়টি, তারপরে মেরিন ড্রাইভ। এসব হচ্ছে এখানকার মূল উন্নয়ন। সাগরের ভাঙ্গনের ঝুঁকি থেকে সৈকতসহ গোটা কুয়াকাটার স্থাপনা সম্পদ রক্ষায় স্থায়ী পরিকল্পনা দ্রত বাস্তবায়ন করার দাবি করেন তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শাহ আলম ভুইয়া জানান, সৈকত স্থায়ী রক্ষায় ‘কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে , যা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে।

তবে শুধু পরিকল্পনায় ২১ টি বছর কেটে গেলেও বাস্তবায়ন আদৌ কবে হবে তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে কুয়াকাটার সকল ধরনের বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারা কুয়াকাটার মূল সমস্যা সাগরের ভাঙন থেকে সৈকত রক্ষায় স্থায়ীভাবে দ্রত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছেন। 

কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ীভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে যথাযথভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, শ্যাওলা ধরা জিও ব্যাগ ও জিও টিউব অপসারণের বিষয়টি বাস্তববসম্মত কি না তাও পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির পক্ষ থেকেও কয়েকবার অবগত করানো হয়েছে। যৌথভাবে সৈকত ভিজিট করা হয়েছে। তবে কুয়াকাটা সৈকতে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানালেন জনাব রবিউল ইসলাম।
 

মো. মহিউদ্দিন

×