ঠাকুরগাঁওয়ে গরুর দুধের নির্যাস থেকে কারখানায় তৈরি হচ্ছে পনির
ঠাকুরগাঁওয়ে গরুর দুধ থেকে উৎপাদিত মানসম্মত মোজারেলা চিজ ও পনিরের চাহিদা দেশ ও দেশের বাইরে দিনের দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েক বছরের ব্যবধানে এ জেলায় এ পর্যন্ত ৩৩টি চিজ বা পনির তৈরির কারখানা চালু হয়েছে। এখানকার তৈরিকৃত চিজ বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় ও রাজধানীর ফাইভস্টারসহ বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে ও ফাস্ট ফুডের দোকানে।
এমনকি এই চিজ রপ্তানি করা হচ্ছে বাইরের দেশেও। ফলে জেলায় এই শিল্পের নতুন নতুন উদ্যোক্তার উত্থানের ফলে কমছে বেকারত্ব, উন্মোচন করছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর নিয়মিত এসব কারখানার উৎপাদিত পণ্য পর্যবেক্ষণ করছে। জেলার বিভিন্ন মোজারেলা চিজ ও পনির উৎপাদনকারী কারখানা, খামার ও এলাকাগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন সকাল হলেই দুধ বোঝাই জ্যারিকেন বাইসাইকেলে, মোটরসাইকেলে অথবা হাতে ঝুলিয়ে দলে দলে খামারি ও গোয়ালারা ছুটে আসছেন দুধ সংগ্রহকারীর নির্ধারিত স্থানে।
চিজ উৎপাদনকে ঘিরে সকাল থেকেই শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। গরুর খামারের ও শ্রমিকরা ঘুম থেকে উঠেই গরুগুলোকে পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দুধ দোহনের কাজে নেমে পড়েন। এখন আর হাত দিয়ে নয়, আধুনিক প্রযুক্তিতে যান্ত্রিক মেশিনের মাধ্যমে দোহন করা হচ্ছে লিটারের পর লিটার দুধ। গরুর জন্য খড়সহ ঘাসও কাটা হচ্ছে মেশিনের মাধ্যমে। এতে খামারিদের কম জনবলে ও পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ে বেশি কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে আগে ক্রেতার অভাবে যেখানে একজন প্রান্তিক খামারি বা গৃহস্থের দিনে উৎপাদিত ২০-৩০ লিটার দুধ বিক্রি করতে নানা ঝামেলা পোহানোসহ হিমশিম খেতে হতো, দুধ নষ্ট হওয়ার ভয় থাকতো। এখন দুধ সংগ্রহের নির্ধারিত অসংখ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠায় নিশ্চিতে ও ন্যায্য দামে দুধ বিক্রয় করতে পারছেন তাঁরা।
এতে কেন্দ্রগুলোতে সকাল হলেই কেউ পায়ে হেঁটে বোতলে করে কেউ আবার মোটরসাইকেল ও সাইকেলে করে দুধ নিয়ে ছুটে আসেন খামারি ও গোয়ালারা। প্রতিদিন দুধ সংগ্রহের এক একটি কেন্দ্রে দুপুরের আগেই ৬শ’ থেকে ৭শ’ লিটার দুধ সংগ্রহ হচ্ছে। আর এসব দুধ চলে যাচ্ছে চিজ উৎপাদন কারখানায়। সেখানে সংগৃহীত দুধ নানান পদ্ধতিতে তৈরি করা হচ্ছে অধিক প্রোটিন ও পুষ্টিযুক্ত চিজ, পনির, ঘি ও বাটার।
আর এসবের নেপথ্যে সকল ধরণের সহায়তা দিয়ে আসছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ) এর রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইস ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট (আরএমটিপি)। এরই আওতায় ঠাকুরগাঁওয়ের পঁঁচটি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫১টি ইউনিয়নে ‘নিরাপদ মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ’ শীর্ষক ভ্যালু-চেইন উপ-প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঠাকুরগাঁওয়ের ইকো-সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)।
যার মাধ্যমে জেলার ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি ও খামারি পরিবার এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিতকরণ ও ভ্যালু-চেইন উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হচ্ছে শক্তিশালী।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগক্তার দেওয়া তথ্য মতে, চিজ তৈরির মাঝারি আকারের প্রতিটি কারখানায় কাজ করছেন ১০ থেকে ৩৫ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিক। প্রতিমাসে ৩৩টি কারখানায় প্রায় একশ’ টন চিজ উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি কেজি চিজ বা পনির বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ থেকে-৬শ’৫০ টাকা দরে। স্থানীয় বাজার মূল্যে মাসে যার দাম প্রায় ৬০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া কারখানাগুলোতে মাসে উৎপাদন করা হচ্ছে ১৬ টন ঘি, ৩ টন পনির এবং দেড় টন বাটার। শুধু স্থানীয়ভাবে দুধ সংগ্রহ করে তা সরাসরি হোটেল-রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করলে যে লাভ হয় তার থেকে কয়েকগুণ বেশি লাভ হচ্ছে মোজারেলা চিজ তৈরি করে বিক্রি করলে। এ কারণে উদ্যোক্তারাও উৎসাহিত হচ্ছেন এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
রিফাত উল্লাহসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা ও চিজ ফ্যাক্টরির মালিক জানান, আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনের মাধ্যমে সহজেই স্বল্প সময়ে দুধ গরম ও শীতলসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে চিজ, পনির, ঘি ও বাটার তৈরি করতে পেরে খুশি তারা। এসব কারখানার তৈরিকৃত চিজসহ অন্যান্য পণ্যগুলো দ্রুত দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। কারণ এই চিজসহ অন্যান্য পণ্যের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এতে খরচ বাদে প্রতি মাসে ৫০ থেকে লক্ষাধিক টাকা লাভ করছেন তাঁরা।
পীরগঞ্জ উপজেলার মেসার্স হাবিব দুগ্ধ খামারের মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রথমে আমি একটি গরু নিয়ে খামার শুরু করেছিলাম। গরুটি দিনে দুধ দিতো ২৫-৩০ লিটার। তখন এক সাথে এতো দুধ বিক্রয় করতে নানা ঝামেলা হতো। গ্রাহকের অভাবে অনেক সময় দুধ নষ্ট হয়েছে। বাজারে ন্যায্য দাম পাওয়া যেত না। এমন অবস্থায় হঠাৎ করেই ইএসডি’র সাথে আমার যোগাযোগ হয়। গ্রহণ করি প্রশিক্ষণ।
তারা নানাভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছে। দিন দিন আমার গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এখন আমার খামারে ৩০টি বিদেশী বিভিন্ন জাতের গাভী রয়েছে। প্রতিদিন ৬শ’ থেকে ৭শ’ লিটার মেশিনের মাধ্যমে দুধ দোহন করছি। আগে আমার দুধ বিক্রি করতে সমস্যা হতো। পরে নিজেই চিজ তৈরির কারখানা স্থাপন করেছি। এখন আমার খামারের দুধ ছাড়াও চিজ তৈরির জন্য দিনে আরও ৫শ’ থেকে-৭শ’ লিটার দুধ ক্রয় করে নিতে হচ্ছে।
আমার গরুর খামারে ও চিজ কারখানায় প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ কাজ করছেন। গরুর খড় ঘাস কাটাসহ দুধ দোহন ও মেশিনে দুধ গরম ও শীতল করে সহজে চিজ তৈরি করতে পারায় পরিশ্রম হচ্ছে কম। তাতে মাসে সবকিছু খরচ বাদ দিয়ে আমর প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হচ্ছে।
এসব কারখানায় ও খামারে কাজ করে ভালোমতো সংসারের খরচসহ সন্তানদের পড়াশোনা চালাচ্ছেন কর্মরত শ্রমিকরা। চিজ উৎপাদন কারখানার এক শ্রমিক ঠাকুরগাঁও শহরের বাসিন্দা রিনা রানী নামে বলেন, আগে বাসায় বেকার বসে থাকতাম। এখন চিজ কারখানা হওয়ায় বাড়িতে বসে না থেকে বেশ কয়েক বছর থেকে আমরা কারখানা গুলোতে কাজ করে ভালো রোজগার করতে পারছি। কাজ করে যা আয় হয় তাতে সংসার ভালোই চলে।
পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ দিতে আর চিন্তা করতে হয় না। নারী শ্রমিক নূর নাহার বেগম বলেন, আগে গ্যাসের মাধ্যমে চুলায় দুধ গমর করতে অনেক সময় লাগতো। এখন মেশিনের মাধ্যমে একসঙ্গে প্রায় ৮শ’ লিটার দুধ গরম ও শীতল করা যায়। এতে অল্প সময়ের মধ্য চিজ তৈরি করতে পারছি এবং আমাদের কম পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
এছাড়া চিজ কারখানা গড়ে ওঠায় দিনের দিন এলাকায় গরুর খামারের সংখ্যা বাড়ছে ও দুধ কালেকশন পয়েন্ট হওয়াতে খামারি এবং গোয়ালারা কোনো রকম ঝামেলা ও চিন্তা ছাড়াই ন্যায্য দামে দুধ বিক্রয় করতে পারছেন। এতে তারাও বেশ লাভবান হচ্ছেন।
পীরগঞ্জ উপজেলার বাঁশগাড়া গ্রামে মেজর বাবু দুধ কালেকশন পয়েন্টে দুধ বিক্রয় করতে এসে বকুল রানী বলেন, আগে তাদের গ্রাম থেকে দুধ নেওয়ার মতো তেমন কেউ ছিল না। তাই অনেক সময় দুধ বিক্রি করতে পারতাম না। এখন দুধ কালেকশন পয়েন্টে এসে প্রতিদিন-১০-১৫ লিটার দুধ বিক্রি করছি। তাতে দামও ভালো পাচ্ছি এবং দুধ বিক্রির টাকা নিয়ে কোনো চিন্তাও থাকে না।
মেজর বাবু দুধ কালেকশন পয়েন্টের মালিক বলেন, দুধ কিনতে আগে বাড়ি বাড়ি যেতে হতো। দিনে মাত্র ১শ’ থেকে ১শ’ ৫০ লিটার দুধ পেতাম। এতে সময় ও পরিশ্রম বেশি হেতো। এখন এলাকায় চিজ কারখানাগুলো হওয়ায় দুধের চাহিদা অনেক বেড়েছে। তাই দুগ্ধ খামার করেছেন অনেকে। আর এখন কালেকশন পয়েন্টেই বসেই দিনে ৬শ’ থেকে ৭শ’ লিটার দুধ ক্রয় করতে পারছি এবং দুধগুলো আশপাশের চিজ কারখানায় বিক্রি করছি।
অপরদিকে দুগ্ধজাত গরুর খামার বেড়ে যাওয়ায় গড়ে উঠেছে ঘাসের বাজার। পীরগঞ্জ উপজেলার ঘাস বাজার কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, শুধু আমাদের একটি বাজারেই প্রতিদিন ২০ হাজার পিস বা ঘাসের আটি বিক্রয় হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২ লাখ টাকা। এতে আমাদের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে ও চাষিরওা দিন দিন ঘাস চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
এদিকে প্রকল্পবাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠান ইএসডিও’র প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, চিজ উৎপাদনের ফলে উদ্যোক্তা, খামারী, গোয়ালা, নারী শ্রমিক থেকে শুরু করে ঘাস চাষিদের বৈচিত্র্যময় কার্যকর উন্নয়ন হয়েছে।
আগামীতে এই ধরনের কার্যক্রম আরও অন্যত্র ছড়িয়ে যাবে এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তাই এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ) এর কর্তৃপক্ষকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান।
এ বিষয়ে জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মাহমুদুল কবির বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ উপায়ে জেলায় চিজ উৎপাদনের ফলে বেকার জনবলের কর্মসংস্থান সুষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই উদ্যোক্তাদের নিয়মিত পরামর্শ ও প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা করছেন তারা।
জেলায় গড়ে ওঠা অধিক প্রটিন ও পুষ্টিযুক্ত চিজ, পনির, ঘি ও বাটার রপ্তানি করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামানা করেছেন উদ্যোগক্তাণ।