জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। অর্থনীতি, ভূগোল ও পরিবেশ, গণিত ও পরিসংখ্যানÑ এ চারটি বিভাগসহ ২৩ জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।
সময়ের ব্যবধানে বেড়েছে বিভাগ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা। হাঁটি হাঁটি পা পা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আজ রবিবার ৫৪তম বছর শেষে ৫৫তম বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে।
জানা যায়, ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট সরকারের এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ঢাকার আদি নাম জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম উপাচার্য হিসেবে বিশিষ্ট রসায়নবিদ অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমদ যোগদান করেন।
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস করা হয়। এই অ্যাক্টে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়। শুরুর দিকে জমির পরিমাণ ছিল ৭৪৮.১৪ একর। তবে বর্তমানে এর আয়তন দাঁড়িয়েছে ৬৯৭.৫৬ একরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বর্তমানে ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ-জেইউ), ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং, তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট এবং ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন পর্যন্ত মোট ৬ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে প্রথম সমাবর্তন এবং ২০২৩ সালে সর্বশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২৪ জন শিক্ষক, ৩৬৬ জন কর্মকর্তা, ৯৪০ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এবং ৫৪৮ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য শতাধিক শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের স্কুল এন্ড কলেজে রয়েছেন ৫৪ জন শিক্ষক। বর্তমানে ১৪ হাজার তিনশ’ ৭৯ জন শিক্ষার্থী (৪৭ ব্যাচ থেকে ৫৩ ব্যাচ) বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। এই শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ২১টি আবাসিক হল রয়েছে। যার ১১টি ছাত্রদের এবং ১০টি ছাত্রীদের জন্য।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রেখে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্বসেরা ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় একাধিকবার এসেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাম। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ (টিএইচই)-এর ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং-২০২৫ এ যৌথভাবে দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে জাবি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও অতুলনীয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শীত মৌসুমে এখানকার স্বচ্ছ পানির লেকে আসে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি। লেকগুলোতে ফুটে থাকা লাল শাপলার বুকে এসব পাখির জলকেলি মুগ্ধ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের। বিশাল জলাশয়যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার।
প্রতিবছর পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনুষ্ঠিত হয় পাখিমেলা। এ ছাড়া এখানে প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ‘প্রজাপতি পার্ক’। প্রজাপতি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রজাপতি মেলা’। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’।
দীর্ঘপথ পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পেয়েছে অসংখ্য গুণী মানুষের সংস্পর্শ। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াৎ মামুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, জাকিয়া বারী মম, সজল নূর, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম প্রমুখ অন্যতম।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দিনব্যাপী নানা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ চত্বর থেকে একটি শোভাযাত্রা শুরু হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে গিয়ে শেষ হবে। বেলা ১১টায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহতের জন্য দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
একই সময়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র চত্বরে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচি রয়েছে। বেলা পৌনে ১২টায় সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে স্মৃতিচারণামূলক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। পরে বিকেল ৩টায় একই স্থানে পুতুল নাচ ও কলতান বিদ্যা নিকেতনের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ তিনটা সাল ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪ অতিক্রম করেছে। ২৪ এর চেতনাকে ধারণ করে এ বছর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হবে। ২৪ এর চেতনাকে বাস্তবায়ন করাই হবে আমাদের কাজ।