শৈশব মানেই দুরন্তপনা। শৈশব মানেই স্মৃতি ও স্বপ্ন-জাগানিয়া সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাটানো সময়। সেই শৈশবের দুরন্তপনা আর প্রকৃতির আলিঙ্গন থেকে সরে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। তাই নতুন প্রজন্মের জীবনস্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব।
সস্তা প্রতিযোগিতাশীল বিবেক-বোধহীন পরিবেশে বড় হচ্ছে আমাদের শিশুরা। ইট, কংক্রিটের ফ্ল্যাট কালচারের আড়ালে শিশুরা ঠিকই বড় হচ্ছে। তবে তারা পাচ্ছে না সোনালি রোদের আলো, বর্ণিল মেঘের ছায়া, রংধনুর আলোর ঝলকানি অথবা নির্মল দামাল বাতাসের দমকা! চার দেয়ালের ভেতর তার জন্য সব বন্দিত্বের আয়োজন! টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ভিডিও গেম আর মোবাইল গেম রীতিমতো ভূতের বোঝা হয়ে চেপেছে শিশুদের মনে। শহুরে শিশুরা নদী দেখে না, সাঁতার জানে না। ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো অসাধারণ রোমাঞ্চকর সাহসিকা তাদের জীবনে ঘটে না! কারণ পারিবারিক সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। শিশুরা পাচ্ছে না যৌথ পারিবারিক বন্ধনের আনন্দমুখরতা। বিচ্ছিন্ন, ছন্নছাড়া পরিবারগুলোর মধ্যে নিরানন্দ বিষণ্নতায় শৈশব কাটছে। স্কুলের হোমওয়ার্ক, গৃহশিক্ষকের পড়া, তারপর বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণে সন্তানদের ওপর চাপিয়ে নাচ, গান প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার চাপে শিশুদের মধ্যে অস্বস্তি আর অস্থিরতা বাড়ছে। নিরানন্দ জীবনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ শিশুরা। অভিভাবকরাও বুঝতে চায় না যে শিশুর জন্য কখন কী প্রয়োজন। শিশুমন কখন কী চায়, তার কী প্রয়োজন তা না বুঝেই তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বাবা-মায়ের ইচ্ছা। সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশুজীবনে প্রকৃতিবান্ধব অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই।
নগরসভ্যতা যেন সমৃদ্ধ শৈশবের সব আয়োজনকে গো-গ্রাসে গিলে ফেলছে। আর ব্যবস্থার নামে অভিভাবকরাও শিশুদের বায়না মেটাচ্ছেন কৃত্রিম আয়োজনে! এভাবে কী শিখবে আমাদের শিশুরা?
শিশুদের জন্য উপযোগী এবং সঠিক জীবন চর্চাই হচ্ছে না। এখন আমাদের পরিবারগুলোয় শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, সহিষ্ণুতা ও শর্তহীন ভালোবাসার চর্চা নেই। সবাই স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। আগে পরিবারে একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিত। পরিবারগুলো ছিল বাবা-মা, দাদা-দাদিকেন্দ্রিক।
গ্রামের সঙ্গে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। বছরে দুই ঈদ ছাড়াও ধান কাটার মৌসুম, শীতের পিঠা-পায়েস উৎসব, বর্ষা ও আম-কাঁঠালের উৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রামে যাওয়া হতো। ফলে শিশুরা পারিবারিক সম্প্রীতির পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্য ও প্রকৃতির আলিঙ্গন পেত। এখন আধুনিকতার নামে কৃত্তিমতা এসে গ্রাস করেছে আমাদের চিন্তা, চেতনা ও রুচিবোধে। কথা হলো এই সমাজে কী করে বোধসম্পন্ন নাগরিকের জন্ম হবে?
শিশুদের গাছে ওঠা বা সাইকেল চালানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ খেলাগুলোয় উৎসাহিত করা উচিত। তাতে একটু-আধটু ব্যথা পেলে বা কেটে-চিড়ে গেলেও ক্ষতি নেই। সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে শিখবে। বাধা-বিপত্তি সম্পর্কে বুঝবে। আরো বুঝবে, যেকোনো কিছু অর্জন করা অত সহজ নয়। সবকিছুই কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। আমরা করছি তার উল্টোটা। অভিভাবকেরা সন্তানদের অনেক চাহিদা নগদ টাকা এবং জিনিসপত্র দেওয়ার মাধ্যমে পূরণ করে থাকি। এ কারণে এসব বিষয় তাদের কাছে খুব সহজলভ্য মনে হয়। চাহিবামাত্র অনেক দামি একটা জিনিস সহজে পেয়ে যাওয়াার কারণে এটা তার কাছে যেমন খুব মূল্যবান কিছু মনে হয় না, তেমনি পরবর্তী বায়না পূরণে তার কোনো বিলম্বও সয়না! বরং তার অস্থিরতা বাড়ে। এসব কারণে সবার আগে আমাদের বুঝতে হবে শিশুর মানসিক চাহিদা কী। সে কী চায়, কেন চায়।
শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে একান্ত কিছু সময় কাটানো। পারিবারিক আলোচনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও তাদের স্বপ্নের কথা জানানো। সন্তানের খোঁজখবর নেওয়া। সন্তানের স্বপ্ন বা ইচ্ছের কথা জানা। পারিবারিক আত্মীয়স্বজনের কাছে নিয়ে যাওয়া। স্বজনদের উপলক্ষে আয়োজনে একত্র করা। স্বজনদের খোশগল্প সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করা। সপ্তাহে অন্তত একদিন সপরিবারে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। হতে পারে কোনো বিনোদন পার্ক, কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, নাটক, সিনেমা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখা। সন্তানদের দাদা-দাদি, নানা-নানির গল্প শুনানো। নিজেদের ছেলেবেলার গল্প শুনানো। গ্রামের বাড়ির গল্প শুনানো। বছরে অন্তত দু-একবার সাধ্যমতো ভ্রমণে যাওয়া। আম-কাঁঠালের মৌসুমে, শীতের পিঠা-পায়েসের উৎসবে, ফসল তোলার মৌসুমে সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া।
মুকসুদপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সচিব মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম বলেন, সন্তানদের গান শেখানো, নাচ শেখানো, ছবি আঁকা, শেখানো, সাঁতার শেখানো, গাছে চড়তে শেখানো, সাইকেল চালাতে শেখানো, পাঠাগারে পাঠানো, গল্পের বই কিনে দেওয়া, বিশেষ দিবসে বই উপহার দেওয়া। বইমেলা, পিঠামেলা, বৃক্ষমেলা, বর্ষা উৎসব, থিয়েটার নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া। সন্তানদের অন্যান্য সহপাঠী-প্রতিবেশী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া। তবে তারা কার সঙ্গে মিশে কী শিখছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। সন্তানদের জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।
মূলত পারিবারিক আলোচনায় সন্তানদের সম্পৃক্ত করলেই এসব বিষয়ে ধারণা পাবে তারা। মনে রাখা দরকার, আমরা অনেকেই পিতা-মাতা হিসেবে সন্তানদের কাছে আদর্শের মডেল হতে পারছি না। সবার আগে আমাদের এ কাজগুলো করা জরুরি।
রাজু