ছবি: জনকন্ঠ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা একসময় তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে নবীনগরের তাঁত শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এই উপজেলার রুপসদী গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সম্ভাবনা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাওয়ার পথে সেই ঐতিহ্য ও সম্ভাবনার দুয়ার। সুতাসহ তাঁত শিল্পের সব উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাঞ্ছারামপুরের তাঁত শিল্প বিলুপ্তির পথে।
প্রায় ৩৫ বছরের মতো তাঁতের কাজ করছেন আবুল কাশেম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের তাঁতশিল্পের সোনালি অতীতের নীরব সাক্ষী তিনি। একসময় এই অঞ্চলে তাঁতের কাজ জানা মানুষের বেশ কদর ছিল বলে জানান তিনি। এই কাজ না জানলে বিয়ে দিতে চাইতেন না মেয়ের অভিভাবকরা। আরেক তাঁত শিল্পী ফরিদ মিয়া হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে বলেন, ‘তাঁতের কাম পারতাম বিধায়, কত মাইয়ার বাপ বিয়া দেওনের লাইগা ঘুরছে।
তার কথার জের ধরে পাশে বসে থাকা তাঁতি আসাদ মিয়া বলে উঠলেন, ‘এহন আর ভাত নাই এই কামে, কেউ দাম দেয় না, টেহা-পয়সা কামাই নাই।’ এক সময় তাঁতের জৌলুস দেখে তার ছেলেকেও এনে ছিলেন এই পেশায়, তবে তাতে হঠাৎ ভাটা পড়েছে বলে জানান তিনি। তাই প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছেন ছেলে।
নব্বইয়ের দশকে তাঁতের প্রসার এই অঞ্চলে। একুশ শতকের শুরুতেই তাতে ভাটা পড়তে থাকে বলে জানায় এলাকাবাসী। আর সেই দুর্দশাই চোখে পড়ল উপজেলার রুপসদী গ্রামের একটি কারখানায়। এক সময় শত শত শ্রমিক কাজ করলেও, এখন হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন!
কারখানায় কাজ করা এক নারী জোহরা বেগম জানান, এক সময় পরিবারের সবাই এই কাজে যুক্ত ছিলেন, এখন মাত্র কোনো রকমে তিনিই করছেন এটি। বর্তমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এই কাজ করা যাবে না বলে জানান এই তাঁতশিল্পী।
স্থানীয়রা জানান, মজুরি কম, বাজারে চাহিদা কম হাতে বোনা তাঁতের। এটিকে এখন পেশা মনে করে না কেউ। সেই সঙ্গে সামাজিক অমর্যাদা রয়েছে। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনাও অনেকটা দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
একসময় সবার বাড়িতে তাঁতের কল থাকলেও এখন সন্ধান পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। এই এলাকায় এখনও প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে হারানো তাঁতশিল্পের ঐতিহ্যের কথা। চা দোকানি রহিস উদ্দিন সবার সামনে বলছিলেন, ‘তাঁত বাইন্নাইয়া সংসার চালাইতাম, আমরার বাইত ও আছিলো তাঁতের কল, শেষ মেষ ধইরা রাখতে পারি নাই, কত মানুষ কাম করতো, সপ্তাহ গেলে ৭০০-৮০০ টেহা কামাই হইতো, এহন তো কেউ বাঁচতে পারে না এই কাম দিয়া।’
এই অঞ্চলে তাঁতকে ঘিরে অনেকে হয়েছেন শিল্পপতি। পুঁজিবাজারে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছেন সারা বিশ্বে। কিন্তু হারিয়ে গেছে সবার ঘরে থাকা তাঁতের কল।
উপজেলার একটি হস্তচালিত তাঁত কারখানার মালিক ফুয়াদ আহম্মেদ বলেন, ‘হাতে বোনা তাঁতের যুগ এখন শেষ বললেই চলে, তাদের মজুরি দিয়ে ব্যবসায় পোষায় না আমাদের, আধুনিক যন্ত্রে কাজ চলায় কোনো রকমে টিকিয়ে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে এই কারখানা, যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে হাতে বোনা তাঁতের কাজ।’
এ নিয়ে সুশীল সমাজের একজন কবির হুমায়ূন বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে তাঁত ছাড়া অন্য বিকল্প তেমন কোনো পেশা ছিল না, আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই অঞ্চলটি বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। পরে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসতে থাকে। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতায় প্রবাসে যাওয়ার হিড়িক উঠে। সেই থেকেই ভাটা ধরেছে এখানে, সবার বাড়িতেই কম বেশি ছিল তাঁতকল, এখানকার মানুষজন এটিকে সম্মানজনক মনে করে না এখন আর। নব্বয়ের দশকেই সপ্তাহে প্রতি তাঁতের কাজ জানা লোকের আয় ছিল ৭০০-৮০০ টাকা, ঠিক এই সময়ে এসেই তাদের আয় একই রয়ে গেছে। অথচ বদলে গেছে পুরো পৃথিবী, টাকার মান আর সব কিছুর দাম।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা তাঁতী মো. হায়দার আলী বলেন, ‘প্রযুক্তির উৎকর্ষতাই দায়ী এই শিল্পের কদর কমে যাবার পেছনে। তাঁতিদের নিয়ে কথা বলার কেউ নেই, তাদের অধিকার নিয়ে কেউ সোচ্চার নয়, সরকার যদি আমাদের এই অঞ্চলে নজর দেয়, তাহলে হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনা সম্ভব তাঁতিদের।’
JF