শ্যালোচালিত বোমা মেশিন দিয়ে (ইনসেটে) নীলফামারীর তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সিলটাপ খনন করা হচ্ছে
কৃষক সাইফুল্লার বাড়ি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়ায়। তিস্তা ব্যারাজের মূল ক্যানেলের পাশে তার বসতভিটা। তিনি বলেন, তার জমি সাড়ে তিন বিঘা। তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার আগে পাট, গম, কাউন, তামাক এসবের চাষ করতেন। সেচের অভাবে ঠিকমতো ফসল উৎপাদন করতে পারতেন না। যার কারণে সংসারে অভাব ছিল। এখন সেই অভাবও নেই।
ব্যারাজ পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। জমির পরিমাণ আগের থেকে কিছুটা বেড়েছে। এখন ১২ মাস সেচ পেয়ে ফসল ফলাতে পারেন। তিস্তা ব্যারাজের সহজেই সেচ পাওয়ায় সাইফুল্লার মতো শত শত কৃষক এখন সচ্ছল। তবে তিস্তা সেচের এতবড় প্রকল্প ঠিকমতো দেখাশোনা করা হয় না বলে কৃষকের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
বুধবার কথা বলে জানা যায়, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া ও লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানি সীমানায় তিস্তা ব্যারাজ। নির্মাণের পর ১৯৯৩ সাল থেকে সেচ সরবরাহ করছে। ৬১৫ মিটার দীর্ঘ ব্যারাজ উত্তর থেকে আসা পানি আটকে দেয়। ব্যারাজে ৪৪টি গেট আছে। উত্তরে পানি বেশি থাকলে বেশিসংখ্যক গেট খুলে দেওয়া হয়।
পানি আসা কমতে থাকলে এক এক করে সব গেট বন্ধ করা হয়। উজানের ভারত থেকে আসা নদীর পানি বাংলাদেশ অংশের তিনবিঘা করিডর দহগ্রাম থেকে পূর্ব ছাতনাইয়ের কালীগঞ্জ হয়ে ডালিয়া পর্যন্ত এই ১৯ কিলোমিটার সেচের পানির আঁধার বা রিজার্ভয়ার হিসেবে কাজ করে। এই আটকানো পানি সেচের জন্য নেওয়া হয় আটটি রেগুলেটর গেট দিয়ে সিলটাপে। তারপর সিলটাপে নদীর কাদা বা ময়লা পানি নেট বা জালের মাধ্যমে ছেঁকে স্বচ্ছ করে ক্যানেলে ছাড়া হয়।
তিনটি জেলার (নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর) ১২টি উপজেলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে প্রকল্পের খাল বা ক্যানেল। এর মধ্যে আছে প্রধান খাল (৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ), মেজর সেকেন্ডারি খাল (৭৪ কিলোমিটার), শাখা খাল (২১৫ কিলোমিটার), উপশাখা খাল (৩৮৮ কিলোমিটার) এবং নিষ্কাশন খাল (৩৮০ কিলোমিটার)।
তিস্তা সেচের সুবিধাভোগী কৃষকদের অভিযোগ- তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হবার পর থেকে সিলটাপ ডেজিং করা হতো বিদেশ থেকে নিয়ে আসা ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে। এতে সিলটাপের গভীরতা ও ক্যানেলের পানি সরবরাহ ভাল হতো। অথচ তিন /চার বছর থেকে সেই ড্রেজার মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফলে কৃষকরা দেখেছেন ২০২০-২১ অর্থবছরে নদী-খাল-পুকুর খনন প্রকল্পের আওতায় সিলটাপসহ ৪টি পুকুর খনন কাজ করেছে বোমা মেশিন বসিয়ে।
এবারও চলতি মৌসুমে বোরো ধান আবাদে আগামী ১৫ জানুয়ারি থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ দেবে ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে। কিন্তু সিলটাপ ভরাট থাকায় ড্রেজার মেশিন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে বোমা (শ্যালো) মেশিনের মাধ্যমে খনন করা হচ্ছে। এতে সিলটাপ পরিপূর্ণভাবে খনন হচ্ছে না বলে জানান কৃষকরা।
সরেজমিনে গেলে বেশ কিছু কৃষক দেখিয়ে বলেন, সিলটাপ খনন করা হচ্ছে পাঁচটি বোমা মেশিন দিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়জন জানালেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নদী-খাল-পুকুর খনন প্রকল্পের আওতায় তিস্তার সেচ প্রকল্পের প্রধান খালে (সিলটাপ) সেচ ক্যানেলে জমে থাকা পলিমাটি অপসারণে খননকাজ শুরু করে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বরাদ্দ ২৯ লাখ টাকা । খনন করছে মেসার্স সাইকি বিল্ডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যেই খননের বালু উত্তোলনের জায়গাগুলোতে তৈরি হয়েছে গভীরতা। অন্যদিকে উত্তোলিত বালু তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ফেলা হচ্ছে, যা নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব কারণে সেচ নালার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে তিস্তা ব্যারাজ ২০০ মিটার দূরত্বে চলছে সেচ ক্যানেলের খনন। ফলে ক্যানেলের তলদেশে প্রায় ২৫-৩০ ফুট গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আশপাশের স্থাপনাগুলোর স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এতে ক্যানেলের দুইপাড় দেবে বাঁধ ও সিসি ব্লক ধসে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদক মুঠোফোনে পাউবোর উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জরুরি মিটিং-এ ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। সিলটাপ খনন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, তিন বছর ধরে ড্রেজার মেশিন নষ্ট। বিদেশ থেকে ড্রেজার মেশিন আনতে ট্রেন্ডার করা হয়। সেটি বাতিল হলে পুনরায় টেন্ডার করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, যেহেতু ড্রেজার মেশিন নষ্ট তাই বিকল্প পদ্ধতিতে (বোমা মেশিন) জরুরিভাবে সিলটাপ খনন করা হচ্ছে। তবে এভাবে সম্পূর্ণ সিলটাপ খনন সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিকভাবে আড়াইশ’ মিটার এলাকা খনন করা হচ্ছে। কারণ সামনে ইরিগেশনে (বোরো ধান) সেচ দিতে হবে (আগামী ১৫ জানুয়ারি থেকে)। এই খননে বরাদ্দ কত জানতে চাইলে তিনি বলেন কোনো বরাদ্দ নেই। জরুরিভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করে খনন কাজটি করা হচ্ছে। বরাদ্দ এলে ঠিকাদারকে হিসাব করে অর্থ প্রদান করা হবে।