![হিমেল হাওয়ায় ফের শীতের দাপট হিমেল হাওয়ায় ফের শীতের দাপট](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/fn-5-2501081659.jpg)
তীব্র শীতে রাস্তার পাশে কাগজ-খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে গা গরমের চেষ্টা।
কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপছে উত্তরাঞ্চল। নীলফামারীতে বৈরী আবহাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত নানান রোগ। দিনাজপুর ও কুড়িগ্রামে বাতাসের সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে শীতের প্রকোপ বেড়েছে। বাগেরহাটে ঠান্ডার অনুভূতি বাড়ায় শীতবস্ত্রের বাজার জমে উঠেছে। এদিকে, যশোরে সর্বনি¤œ তাপমাত্রার রেকর্ডের দিন ফরিদপুরে সূর্যের দেখা মেলেনি কোথাও। এতে বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
নীলফামারীতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মানেই চোখের সামনে হাড় কাঁপানো শীতের ছবি। তবে, গত দুদিনে তাপমাত্রা ওঠা-নামা হয়েছে। হিমালয়ের কোলঘেঁষা সিকিমের তুষারপাতের হাওয়া এসে লেগেছে নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। বুধবার দুপুরের পর উত্তরের হিম বাতাস প্রায় ৮ কিলোমিটার বেগে বইছিল। পথে চলাচলে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। কুয়াশায় ঢাকা ছিল বিভিন্ন এলাকা।
শীতে উষ্ণতার জন্য গরম কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। সঙ্গে বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষের হাহাকার। বৈরি আবহাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে নিউমোনিয়া, সর্দি, জ্বর, কাশিসহ ঠান্ডাজনিত নানান রোগ।
কলেজছাত্র মোবারক হোসেন জানান, আমাদের এলাকা থেকে সড়কপথে সিকিমের দূরত্ব ১৫৪ কিলোমিটার। কিন্তু আকাশপথে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের মতো। খবর পেলাম দুদিন ধরে সিকিমে তুষারপাত হচ্ছে- তার হাওয়া আকাশপথে এ এলাকায় এসে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে।
শ্রম বিক্রি করতে আসা রহমান বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ, ঠান্ডা হোক আর গরমে হোক কাম করিবার লাগবেই। একদিন কাম না করলেও খামো কী? কায় হামাক খাবার দেবে। ঠান্ডা বাতাসোত কষ্ট তো হওচে। কিন্তু কিছুই করার নাই। কোনোটে কামের খোঁজ আসলে যাওয়া লাগবেই। হামরা ঠান্ডাত মরি যাওছি।’ শুধু দিনমজুররা নয়, তীব্র শীতে কাতর শিশু ও বৃদ্ধরা। খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে হতদরিদ্র মানুষ।
আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, বাতাসের আর্দ্রতা কাছাকাছি হওয়ায় বায়ুম-ল উত্তপ্ত হতে না পারায় সূর্যের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেটাও উত্তাপহীন। সঙ্গে ঝড়ছে শীত, আছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা। এই অঞ্চলে তাপমাত্রা অনেক স্থানে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আগামী ৯ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা আবার কমবে। এ সময় তাপমাত্রা ৭/৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামবে। আবহাওয়ার এই কঠিন পরিস্থিতি পুরো মাসজুড়ে থাকতে পারে। দিনাজপুর ॥ জেলায় সকাল থেকে ওঠেনি সূর্য, হয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এ অবস্থায় রাস্তাঘাটে লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। আগামী ২-৩ দিনে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে আরও কমবে। দিনের তাপমাত্রা ৫ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
অবস্থানগত কারণে যেসব এলাকায় শীতের তীব্রতা এবং বাতাসের প্রভাব বেশি তার মধ্যে অন্যতম উত্তরের জেলা দিনাজপুর। কয়েকদিন ধরে জেলায় হিমেল বাতাসের প্রভাব না থাকলেও মঙ্গলবার বিকেল থেকে ফের শুরু হয় হিমেল বাতাস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাতাসের গতিবেগ বাড়ায় কমবে তাপমাত্রা। দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, বুধবার সকাল ৬টায় জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৫ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকাল ৯টায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার। এতে করে দিনের তাপমাত্রা ৫ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রাও ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
এর আগে, মঙ্গলবার এই জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় এক কিলোমিটার। সোমবার এই জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৩ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা জানান, গত কয়েকদিন ধরেই হিমালয়ের সামনে একটি ঘূর্ণায়মান অর্থাৎ বৃহৎ আকারের জলীয় বাষ্পের বলয় বিরাজ করছে।
যেটি একটি প্রাচীরের মতো কাজ করছে এবং উত্তরের হিমেল বাতাসকে আটক দিয়েছে। ফলে গত কয়েকদিন ধরেই এই এলাকার ওপর দিয়ে হিমেল বাতাস প্রবাহিত হয়নি। এতে করে শীতের তীব্রতা কমেছিল, বেড়েছিল তাপমাত্রা। তবে হিমালয়ের কাছে থাকা জলীয় বাষ্পের বলয়টি দ্রুত গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরে যাওয়ার কারণে, উত্তরের জেলাগুলোতে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় বৃষ্টির আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে এবং বুধবার রাত থেকেই তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস পেতে পারে।
৯ বা ১০ তারিখ থেকে কিছু কিছু স্থানে শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করতে পারে, যেটি পরবর্তীতে আরও বিস্তার লাভ করবে। আবহাওয়াবিদ তোফাজ্জল হোসেন বলেন, উত্তরের হিমেল বাতাস সক্রিয় হয়ে পড়েছে এবং বাতাসের গতিবেগ বেড়ে গেছে। এটা দুই থেকে তিনদিন অব্যাহত থাকবে। পরে তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমবে।
কুড়িগ্রাম ॥ জেলা ও তার আশপাশে হিমালয়ের বরফ ছোঁয়া আর কনকনে ঠান্ডা বাতাসে কাহিল হয়ে পড়েছে জনপদের মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ আর গবাদি পশু পাখি। বুধবার সারাদিন মেঘে ঢাকা ছিল পুরো অঞ্চল। তবে, তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেলেও কমেনি শীতের তীব্রতা। বুধবার জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকেলের পর বাতাসের তীব্রতা বেড়ে যায়। রাত যতই গভীর হয় ঠান্ডার তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। কনকনে ঠান্ডায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন।
প্রচ- ঠান্ডায় হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি। কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮শ’ মানুষ ঠান্ডাজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে আসছে।
কুড়িগ্রাম আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, আকাশে মেঘ থাকায় তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। এ ছাড়া, জেলার বিভিন্ন এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও ॥ ৪-৫ দিন বিরতির পর জেলায় বুধবার থেকে আবার কনকনে বাতাস ও ঘন কুয়াশায় জেঁকে বসেছে শীত। এতে ছন্দপতন ঘটছে স্বাভাবিক জীবনের। নৈশপ্রহরী রাতের অধিকাংশ সময় খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে বসে থাকছেন। দিনমজুররা কাজের জন্য শহরে এসে অপেক্ষা করে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন। ঘন কুয়াশায় বুধবার সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। সড়কে যানবাহন চলছে হেডলাইট জ্বালিয়ে।
শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। সদর হাসপাতালে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নতুন করে ৬৫ জন শিশু ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে।
জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা শহরে ও গ্রামে দিনে-রাতে এতিমখানাসহ হতদরিদ্রদের বাড়িতে গিয়ে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
বাগেরহাট ॥ কনকনে ঠান্ডায় জেলায় শীতবস্ত্রের বিক্রির ধুম পড়েছে। বুধবার সারাদিন সূর্যে দেখা যায়নি। তীব্র ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে সর্বত্র। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ শীতল হাওয়ায় কষ্টে আছেন।
এ অবস্থায় বাগেরহাটের নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য গরম-কাপড়ের দোকান ও ফুটপাতে শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে ভিড় বাড়ছে। দরগা মাজারের মাঠ, পুরাতন কোর্ট চত্বর, কোর্ট প্রাঙ্গণ, রেলস্টেশন, নিক্সন মার্কেটসহ বিভিন্ন বাজারে শীতবস্ত্র কেনার হিড়িক পড়েছে।
মোংলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, বাগেরহাটে বর্তমানে ১২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহের এ প্রভাব আনুমানিক দুই থেকে তিনদিন থাকবে।
যশোর ॥ যশোরে বুধবার দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এদিন সকাল ৬টায় এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সর্বনি¤œ তাপমাত্রার পাশাপাশি কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা ও হাড় কাঁপানো বাতাসে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এতে দিনমজুর শ্রেণির নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে বিপাকে। যশোর মতিউর রহমান বিমানঘাঁটি আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, বুধবার সকাল ৬টার দিকে যশোরে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। যা দেশের সর্বনিম্ন। এই তাপমাত্রার পাশাপাশি কয়েকদিন ধরে রাতে ও সকালে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে গোটা এলাকা। সেই সঙ্গে হাড় কাঁপানো বাতাসে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে দিনমজুর শ্রেণির নি¤œ আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে।
শীত ও ঠান্ডা বাতাসে প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাড়ির বাইরে আসেননি। শহরের সড়কে তুলনামূলক যানবাহনও কম দেখা গেছে। আজও যশোরে তাপমাত্রা কম থাকবে। শীতের মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে যশোর মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটি আবহাওয়া দপ্তর।
ফরিদপুর ॥ হিমেল হাওয়ায় ফরিদপুরের জনজীবনে জুবুথবু অবস্থা। বুধবার মধ্য দুপুর পর্যন্ত ফরিদপুরের কোথাও সূর্যের দেখা মেলেনি। এতে করে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ আয়ের মানুষজন। পেটের দায়ে শীতে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষ। স্কুল-কলেজগুলোতে উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা।
ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দেবব্রত দত্ত বলেন, প্রচন্ড শীতে বিদ্যালয়সহ আশপাশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছেন না।
ফরিদপুর ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা প্রদ্যুৎ কুমার সাহা জানান, হাসপাতালটিতে শিশুদের চিকিৎসা করা হয়। বর্তমানে অন্য সময়ের চেয়ে ঠান্ডাজনিত শিশু রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। শীত ও কুয়াশায় মহাসড়কগুলোতে মোটরসাইকেল চালকদের খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। যাত্রীবাহী বাস হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে।
শীতে বয়স্করা সমস্যায় পড়েছেন বেশি। তাদের মধ্যে শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। ফরিদপুর সদর হাসপাতালের সামনে অভ্র ড্রাগ হাউসের খোকন কুমার রাহুত জানান, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তার দোকানে শীতজনিত রোগের ওষুধ বেশি বিক্রি হচ্ছে।