বাঁধ নির্মাণের জন্য পদ্মায় জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ চলছে
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা পেয়ে প্রমত্ত পদ্মার গতিপথ বদলে ভয়াল আগ্রাসনে ভাঙছে নদীর পাড়। এতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে পদ্মাপাড়ের জনপদ। ভয়াবহ এ ভাঙন বিপর্যয় ও পদ্মার আগ্রাসন ঠেকাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় ‘পদ্মা নদীর ভাঙন হতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এবং কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কোমরকান্দি রক্ষা শীর্ষক প্রকল্প’। অনুমোদিত হওয়ার পর প্রকল্পটি এখন বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম অবহেলা গাফিলতি ও অনিয়মে অনিশ্চয়তার মুখে প্রকল্পটি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ধসে যাওয়ার শংকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।
তাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কতিপয় অসাধুকে অবৈধ সুবিধা দিতে এমন অনিয়ম ও ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নাধীন জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে কিছু অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলেও অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো দ-প্রাপ্ত অযোগ্য ও কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বিডিপিএলকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ দেওয়ার চেষ্টাকে অস্বীকার করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সংযোগ স্থাপনকারী (ঈশ^রদী-কুষ্টিয়া মহাসড়ক) মহাসড়ক, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, সেচ প্রকল্প, ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সরকারি-বেসরকারি নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো, ঘরবাড়ি কৃষিজমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকাকে পদ্মা নদীর ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় নদীর ডান তীরে প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘের প্রকল্পটির আংশিক কিছু স্থানে ইতোমধ্যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
তবে একযোগে কাজ না হওয়ায় চরম বিক্ষুব্ধ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, এভাবে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত স্থানে কাজ করার ভয়াবহ পরিণতি ঘটেছিল শিলাইদাহ রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে। এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও পানি উন্নয়ন বোর্ড কার স্বার্থে আবার সেই একই ঘটনার আশঙ্কাকে তুচ্ছ করে দেখছেন? অবিলম্বে জরুরি ভিত্তিতে সৃষ্ট জটিলতার নিরসন করে অদক্ষ প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করে একযোগে কাজ শুরুর দাবি স্থানীয়দের।
এ বিষয়ে মতিন কন্সট্রাকশন লিমিটেডের সাইট ম্যানেজার রুপম হোসেন বলেন, ‘পদ্মা নদীর ডান তীরে প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘের প্রকল্পটির অতি জরুরি ভিত্তিতে আংশিক কিছু স্থানে ইতোমধ্যে কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও আমরা আশঙ্কা করছি, নিয়ম বহির্ভূত এই প্রক্রিয়ায় আংশিক স্থানে যে কাজ হচ্ছে এবং সরকারের অর্থব্যয় হচ্ছে তা পুরোটায় গচ্ছা যেতে পারে। এতে সময়মতো এবং সঠিক পদ্ধতিতে মানসম্মত কাজ অনিশ্চিত হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই’।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়নে ১৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘কুষ্টিয়া জেলায় বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ^বর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ’ প্রকল্পের সুলতানপুর অংশে ২ হাজার ৭২০ মিটার এবং শিলাইদহ অংশে ১ হাজার মিটার সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেড বা বিডিপিএলের সঙ্গে যোগসাজশে অবৈধ সুবিধা লাভের বিনিময়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ওই বাঁধটি নির্মাণকালেই ধসে যায়।
এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়। বিষয়টি মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির (আইএমইডি) প্রতিবেদনে সত্যতা উঠে আসায় তাৎক্ষণিক প্রকল্প পরিচালককে ভর্ৎসনা করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিডিপিএলকে ক্ষতি পূরণ বাবদ ২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে অযোগ্য বা কালো তালিকাভুক্ত করেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের সঙ্গে ৭ বছর পূর্বে ধসে যাওয়া এবং অসম্পূর্ণ প্রায় ১.৫৩ কিলোমিটার কাজও সংযুক্ত রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাসির উদ্দিন মোল্লা এন্টারপ্রাইজের সাইট ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম বহির্ভূত প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার ফলে শিলাইদাহ বাঁধে দুই অংশের মাঝখানে ১ হাজার ৫শ’ ৩০ মিটার কাজ না হওয়ার কারণে পানির চাপে নির্মিত বাঁধ ধসে গিয়ে ওই বাঁধটাই ক্ষতিগ্রস্ত ও চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের চোখের সামনে এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও কীভাবে এই ধরনের বাঁধ নির্মাণে এমন অযোগ্য কালো তালিকাভুক্ত বিডিপিএল এখানে কাজ করবে? নিশ্চয় কোনো অবৈধ সুবিধার আশায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়নাধীন এই বিশাল প্রকল্পে কাজ দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে? ন্যাচারাল কন্সট্রাকশনের স্বত্বাধিকার এহসানুল হক বাবুর অভিযোগ, ‘ভাঙন কবলিত নদী তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজের প্রধান পূর্বশর্ত হলো সমগ্র প্রকল্প আয়তনের পুরোটা একযোগে কাজ শুরু করা।
নচেৎ পানির তলদেশে এই কাজ বিচ্ছিন্নভাবে করলে সেই কাজের সামনে বা পেছনে, ডানে বা বামে পানির তলদেশে স্কাউরিং সৃষ্টি হলে চলমান কাজে ধস বা ওয়াস আউট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পরে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান জানান, ‘১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে ২ বছর বাস্তবায়নককাল ধরে শুরু হওয়া পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধের কাজ ৩২টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
ইতোমধ্যে ১৮টি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। অবশিষ্ট প্যাকেজগুলোর কার্যাদেশ এখনো দেওয়া হয়নি। এতে ৫.৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের ১৫টি প্যাকেজের কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। কিছু জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এমনটি হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও আদেশ পেলেই উদ্ভূত জটিলতা কেটে যাবে।
তবে এক্ষেত্রে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিশেষ কোনো অযোগ্য কালো তালিকাভুক্ত বা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক দ-প্রাপ্ত বিডিপিএলের মতো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেই অভিযোগ সঠিক না’।