প্রবীর মিত্র
চিরনিদ্রায় শায়িত দেশীয় চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনেতা প্রবীর মিত্র। সোমবার বিএফডিসি ও চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বিকেল তিনটা ৪০ মিনিটে তাকে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাকে বিএফডিসিতে শ্রদ্ধা জানান দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা।
প্রয়াত এ অভিনেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এফডিসিতে এসেছিলেন অভিনেতা মিশা সওদাগর, আলমগীর, সুব্রত, বাপ্পী চৌধুরী, মেহেদী, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, নাসরিন, রোমানা মুক্তি, পরিচালক ছটকু আহমেদ, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, শাহিন সুমন, মুশফিকুর রহমান গুলজার, সাইফ চন্দনসহ চলচ্চিত্র জগতের অনেকে।
তাকে আরও শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস), চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি, ফিল্ম ক্লাবসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সদস্যরা।
রবিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঢাকাই সিনেমার রঙিন নবাবখ্যাত অভিনেতা প্রবীর মিত্র। সোমবার দুপর সাড়ে ১২টার দিকে এফডিসিতে আনা হয় তার মরদেহ। লাশবাহী গাড়ি এফডিসিতে পৌঁছানোর পর ভারি হয়ে ওঠে পুরো চত্বর। কান্নায় ভেঙে পড়েন দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। দুপুর একটা ৪০ মিনিটে এফডিসির জহির রায়হান ভিআইপি প্রজেকশনের সামনে অনুষ্ঠিত হয় ৮৩ বছর বয়সী এই অভিনেতার প্রথম জানাজা। সেখানে জানাজা শেষে তার মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে।
এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সবাইকে চলে যেতে হবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু কে কীভাবে যাবে, সেটাই
হলো তার ভাগ্য। আখিরাত যার সুন্দর হবে, তিনি হলেন সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান। সেদিক দিয়ে আমাদের প্রবীরদা অনেক ভাগ্যবান। দীর্ঘ সময় তিনি অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন। এই সময়টা তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ছিলেন। সহকর্মী হিসেবে আমরা তাকে দেখেছি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ।
সবার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এফডিসিতে প্রবীর মিত্রর জানাজা সম্পন্ন হয়। দুপুর পৌনে দুটায় এফডিসি থেকে মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। এরপর সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম, ফুয়াদ নাসের বাবু, অভিনয়শিল্পী খাইরুল আলম সবুজ, মিশা সওদাগরসহ প্রবীর মিত্রের পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। পরে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে খান আতাউর রহমান বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমাটি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে প্রদীপ দে নির্মাণ করেন ‘রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা’। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দেশের বরেণ্য অভিনেতা প্রবীর মিত্র।
প্রবীর মিত্রের দুই পায়ের হাটুতে সমস্যার কারণে দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। বড় ছেলে মিথুন ও মেজ ছেলে নিপুণের কাছে একসঙ্গে ছিলেন রাজধানীর ধানম-ির আট নম্বর রোডের এক বাসাতে। জীবনের শেষ সময়টা সেখানেই কাটে প্রবীর মিত্রের। দীর্ঘ চার বছর যাবৎ এই বাসাতে ছিলেন প্রবীর মিত্র। প্রবীর মিত্রের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান।
তার সঙ্গে শেষবার আড্ডাও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষমেশ তা আর হলো না। জীবনের শেষ সময়ে এসে কাউকে আর এক নজর দেখারও আগ্রহ প্রকাশ করেননি এই অভিনেতা। মিথুন জানান, তার বড় বোন ফেরদৌস পারভীন প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন বাবাকে দেখতে। সবাই মিলে বাবাকে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতেন বাবাকে। মিথুন জানান, তার মা নাজমুন্নাহার মারা গেছেন ২০০০ সালে। আর তার ছোট ভাই আকাশ ২০১২ সালে মারা গেছেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন অভিনয়শিল্পীর অভিনয়ের স্থান থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের সরিয়ে নিতে হয় যেন তারই প্রমাণ বহন করছিলেন প্রবীর মিত্র। যে কারণে প্রবীর মিত্রর মতো একজন গুণী শিল্পী ‘বৃদ্ধাশ্রম’ নামে একটি চলচ্চিত্রেই সর্বশেষ অভিনয় করেন। শুধু সিনেমাপ্রেমী দর্শকের কাছেই নয়, প্রবীর মিত্রর সহকর্মীদের কাছেও প্রবীর মিত্র ভীষণ প্রিয় ছিলেন। কিন্তু তেমন কেউই তার খোঁজ রাখতেন না।
সব সময়ই সাদাসিধে জীবন পছন্দ ছিল প্রবীর মিত্রর। যে কারণে উচ্চাভিলাষ তাকে কখনোই পেয়ে বসেনি। জীবনের মতো করেই জীবন চলে গেছে। জীবনের নিয়মে জীবন চলে যাচ্ছিল। বয়স বাড়ছিল, তাও মেনে নিয়েছিলেন। আর তাই সব মেনে নিয়েই চলচ্চিত্র থেকে অনেকটা দূরেও চলে গিয়েছিলেন তিনি।
বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। প্রবীর মিত্রর ভাষায় তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি ‘নয়নের আলো’। সুমিতা দেবী এই ছবিতে প্রবীর মিত্রর অভিনয় দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পাও, তাহলে অভিনয় ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেও।’
কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না মিললেও প্রবীর মিত্র তার দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে, ভালোবাসার জায়গা থেকে অভিনয়ই করে গেছেন আজীবন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সে ছবিতে না পেলেও পরে তিনি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন। যাই হোক একবার রাজেশ খান্না ও শাবানাকে নিয়ে প্রমোদ চক্রবর্তী ‘বিরোধ’ ছবিটি নির্মাণের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।
ঢাকায় এসে তিনি প্রযোজক হাবিবুর রহমানের কাছে ঢাকার কয়েকটি ছবি দেখতে চাইলেন। তখন তাকে ‘নয়নের আলো’ এবং ‘ছুটির ঘণ্টা’ এই ছবি দুটো দেওয়া হয়। দুটি ছবিই প্রমোদ চক্রবর্তী মনোযোগ দিয়ে দেখেন। ফেরার সময় বিমানবন্দরে হাবিবুর রহমানকে বলছিলেন, ‘নয়নের আলো’ ছবির সেকেন্ড হাফ আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। প্রবীর মিত্রকে আমাকে দিয়ে দেন। জবাবে তখন হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, সে তো অনেক ব্যস্ত, যেতে পারবে না।
যাই হোক, পরবর্তীতে প্রমোদ চক্রবর্তীর সঙ্গে বোম্বেতে শূটিং করতে শাবানাও যান। তার কাছেও প্রমোদ চক্রবর্তী প্রবীর মিত্রর না যাওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। একদিন এমএ সামাদ পরিচালিত ‘শিরী ফরহাদ’ ছবির শূটিংয়ের সময় বিএফডিসির চার নম্বর ফ্লোরের মেকআপ রুমে মেকআপ নিচ্ছিলেন প্রবীর মিত্র। তাকে দেখে শাবানা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। প্রবীর মিত্র খানিকটা ভয় পেয়ে এফডিসির পুকুর পাড়ে শূটিংয়ে চলে গেলেন।
সেখানে শাবানা তাকে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘প্রমোদ চক্রবর্তী আপনাকে ডাকলেন, আর আপনি গেলেন না! এটা কী করে মেনে নেই!’। প্রবীর মিত্রকে ঘিরে এতসব ঘটনা কিন্তু বেলাল আহমেদের ‘নয়নের আলো’ ছবির জন্যই। চলচ্চিত্রে প্রবীর মিত্রের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে। মূলত ছবিতে কাজের ব্যাপারে তার বন্ধু এটিএম শামসুজ্জামানই তাকে সহযোগিতা করেছিলেন।
‘জলছবি’র পর নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্র ‘চাবুক’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, জালিয়াত’, ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘রামের সুমতি’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’সহ আরও বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে শিল্পী আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে আমার পৃথিবী থেকে’ গানটি তাকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি এনে দেয়।
১৯৮২ সালে তিনি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এরপর আরও বহু চলচ্চিত্রে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেছেন। প্রবীর মিত্রের দুই বোন। একজন সরস্বতী বসু অন্যজন রমা সরকার। ছোট ভাই সুবীর কুমার মিত্র।
রাজধানীর তাঁতীবাজারের হরিপ্রসণœ মিত্র রোড প্রবীর মিত্ররই দাদার নামে। প্রবীর মিত্রর বাবা গোপেন্দ্র নারায়ণ মিত্র এবং মা অমীয় বালা মিত্র। নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্রের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল জহির রায়হানের শেষ সহকারী শেখ নজরুল ও ইলতুত মিস পরিচালিত ‘চাবুক’। এতে প্রবীর মিত্রের নায়িকা ছিলেন কবরী।