বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে সৃষ্ট দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে সৃষ্ট দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত থেকে সংবাদ মাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে।
রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে কথাগুলো বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। এ সময় কমিশনের সদস্য গীতিআরা নাসরীন, আখতার হোসেন খান, বেগম কামরুন্নেসা হাসানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
কামাল আহমেদ বলেন, সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা নেই, এ কথা ঠিক না। সাংবাদিকতার নীতিমালা অনেকগুলো আছে। তবে সম্পাদকীয় নীতিমালা নেই। সারা দেশে সম্পাদকীয় মান ও অভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিত, যা সবাই মেনে চলবেন। কিন্তু সেরকম কোনো কিছু নেই। সেজন্য আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি জাতীয় নীতিমালার জন্য, বলেছি একটি ন্যূনতম মান নির্ধারণ করার জন্য, যেটি মেনে চলার জন্য।
পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে অনেক নীতিমালা আছে, সমস্যা হচ্ছে, সরকার সেসব নীতিমালা মানেনি। সরকার মানে হল কর্মকর্তারা। তারা রাজনৈতিক প্রভাবে অথবা অন্য কোনো কারণে বা সেটা দুর্নীতিও হতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান বেতনও দিতে পারে না। চলে যায় কার্ডের ব্যবসায়। একটা দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। এ দুষ্টচক্র ভেঙে শৃঙ্খলা আনতে হবে।
সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিগত বছরে যেসব সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। গত পনেরো বছরে যেসব ভুয়া পত্রিকা নিবন্ধিত হয়ে ডিএফপির তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোকে বাদ দিতে হবে।
পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগদান করতে হলে সাংবাদিকতায় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে বা সাংবাদিকতায় পেশাগত ডিগ্রি থাকতে হবে। উপজেলা এবং মফস্বল এলাকার প্রেস ক্লাব সভাপতি ও সম্পাদককে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য নির্বাচিত করা এবং মফস্বল সাংবাদিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে সাংবাদিক লেখা স্টিকার ব্যবহার করে ভুয়া সাংবাদিকরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে আসছে। এসব ভুয়া সাংবাদিকতা বন্ধের জন্য প্রেস ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা চালুকরণ বা সাংবাদিকদের মান উন্নয়নের জন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাংবাদিকদের একক রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান ও তাদের সরকারি পরিচিতি নিশ্চিত করতে হবে।
ফলে একজনের একাধিকবার সরকারি সুবিধাপ্রাপ্তি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পিআইডির তত্ত্বাবধানে সাংবাদিকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ জন্য পিআইডিকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রেস ক্লাবসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনকে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনলে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।
কমিশন প্রধান জানান, একই প্রতিষ্ঠানে টিভি, রেডিও, অনলাইন এবং সংবাদপত্র বাংলা এবং ইংরেজি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, একই হাউস থেকে একাধিক বাংলা পত্রিকা বের হচ্ছে। পাঠক কী পাচ্ছে? একই জিনিস দুই নামে বের হচ্ছে। তাহলে তো পাঠক ভিন্নমত, ভিন্নচিত্র এটা দেখতে পারছেন না। বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতা থাকছে না। এ সমস্যাগুলোর সমাধান আমাদের খুঁজতে হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান আরও বলেন, এমনও উপজেলা আছে যেখানে ৪টি প্রেস ক্লাব। এটা হলো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। প্রেস ক্লাব করলে মনে হয় কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, ক্লাবের নেতা হলে আলাদা মর্যাদা, একটু আর্থিক কোনো ব্যাপার থাকতে পারে, সে কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এসবের সমাধান আমরা করতে পারব না। সেসবের সমাধান আমাদের কাছে জানা নেই। আমরা বলতে পারি যে, এ সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে, কীভাবে সমাধান করা যায়।
একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মন্তব্য করেন তিনি বলেন, এটি শুধু সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে না, টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। বাংলাদেশে ৪৬টি টেলিভিশন চ্যানেল চলার বাজার নেই। কিন্তু ৪৬টি টিভি চ্যানেলকে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ টিভি চ্যানেলগুলোর যেহেতু বাজার নেই, সে কারণে তারা আয়ও করতে পারে না।
তখন নিয়োগ দেয় বিনা বেতনে। এসবের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা ভালো সমাধান হতে পারে। কমিশন প্রধান বলেন, ন্যূনতম বেতন সারা দেশের সাংবাদিকতার জন্য থাকবে। আর যে শহরে খরচ বেশি, বিশেষ করে ঢাকায়Ñ সেখানে জীবনযাত্রা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। রাজধানীর জন্য আলাদা করে ভাতা, তাদের জন্য বেতন একটু বেশি হবে। যতটা প্রয়োজন ততটা বেশি হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকগণ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের ৮টি জেলার সাংবাদিক ও চট্টগ্রাম পিআইডির উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মো. সাঈদ হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামানসহ বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সভায় উপস্থিত ছিলেন।