ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১

খেজুরের রসে, পিঠাপুলিতে বিন্দুভিটায় স্মৃতিমেদুর আয়োজন

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

খেজুরের রসে, পিঠাপুলিতে বিন্দুভিটায় স্মৃতিমেদুর আয়োজন

গাজীপুরের শ্রীপুরের বিন্দুভিটায় রসমেলা শুরুর পূর্বে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়

‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয় ...।’ ঋতুচক্রের পালাবদলে প্রকৃতিতে চলছে শীতকাল। ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে শীতকালে প্রকৃতি ধরা দেয় ভিন্ন এক রূপে। বিশেষ করে গ্রামবাংলায় সেই রূপটি বড় মোহময়। হিমহিম সকালের মিঠে রোদে খেজুরের টলটলে রস সেইসঙ্গে পিঠাপুলি গ্রামীণ জীবনে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় শীত। তবে ইট-পাথরের দালানকোঠায় আবৃত শহর ঢাকায় সেই সুযোগটি সহজে মেলে না। তাই বলে কি থেমে থাকে সংস্কৃতিপ্রেমী নাগরিকের শীতকাল উদ্যাপন?

শনিবার শেকড়সন্ধানী গুটিকয় শহরবাসী ঠিকই মেতে উঠলেন শীতকালের উদ্যাপনে। খেজুর গাছ থেকে নামানো খেজুরের রসপান করে আলিঙ্গন করলেন আপন সংস্কৃতিকে। মেতে উঠলেন পৌষ উদ্যাপনের আবাহনে। তাই পৌষের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা ঢাকা ছেড়ে সমবেত হয়েছিলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিন্দু বাড়ি গ্রামে। শালবনের সঙ্গে গজারিসহ রকমারি গাছপালা ও লতাপাতায় ঘেরা ওই গ্রামের বেনুভিটায় হয়ে গেল আনন্দমুখর রস মেলা।

রসপানের সঙ্গে গুড়, মুড়ি, মোয়া, বাতাসা কিংবা নকুল দানার মতো মজাদার খাবারের নাশতা রাঙিয়েছে মেলায় আগতদের মন। বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের কথা। ভর করেছিল স্মৃতিকাতরতা। রসপানের এ আয়োজনের সমান্তরালে দিনভর চলেছে একঝাঁক চিত্রশিল্পীর ছবি আঁকাআঁকি। 
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল আটটা। হিমেল সকালে বিন্দুভিটা তখন কুয়াশা চাদরে মোড়া। সময় গড়ালে ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর ভেদ করে নজরে পড়ে বেশকিছু খেজুর গাছ। তার পেছনে সারি সারি শালবন। কানে আসে পাখির কিচিরমিচির। সেই ¯িœগ্ধ ও সুরেলা আবহে শুরু হয় রসমেলা। ভিটার উঠানে দুইটি আমগাছের মাঝের ফাঁকা জায়গায় বিছানো টেবিলে জড়ো হতে থাকে রসের হাঁড়ি। ওই ভিটার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খেজুর গাছ থেকে গাছি নামিয়ে আনছিলেন রসে ভরা হাঁড়িগুলো।

এরপর পোড়ামাটির গ্লাসে ঢেলে দেওয়া হচ্ছিল রস। ততক্ষণে টেবিলটি ভরে গেছে গ্রামবাংলার প্রচলিত মজাদার নানা খাদ্য। বেতের ডালায় শোভা পাচ্ছিল মুড়ি, কদমা, নকুলদানা, কটকটি, বাতাসা, মুড়ালি, তিলুয়া, বাদামচিসহ মুখরোচক খাদ্য। এরপর আসে মেলা শুরুর পালা। গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। সকলে মিলে এক স্বরে গেয়ে ওঠেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ...।’ গান শেষে আপ্যায়ন পর্ব। 
এই রসমেলার আয়োজক বেনুভিটার স্বত্বাধিকারী শাহজাহান মৃধা। আপন কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অনুরাগী এই সংগঠক জনকণ্ঠকে বলেন, এদেশের সংস্কৃতির কোনো তুলনা নেই। এদেশের বাউলরা একতারা হাতে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি ভিখ মেঙে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়। 
অন্য কোনো দেশে এই সরল জীবনাচরণের দেখা মেলে না।  তেমনি এদেশের মানুষের এসব আবেগও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এদেশের সংস্কৃতির কোনো তুলনা নাই। তাই বাঙালিত্ব অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সেই সমৃদ্ধ বাঙালিত্বের সঙ্গে পৌষের আবাহন উদ্যাপনেই এই রসমেলার আয়োজন। এতে করে আমাদের বাঙালিত্বের চর্চাটা অব্যাহত থাকবে।     
মেলা প্রাঙ্গণে গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাতে দেখা যায় গাছি আবদুল হামিদকে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে গাছের রস নামাই। অনেকেই কাঁচা রস খান।  বাকিটা দিয়ে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। ঝোলা গুড় থেকে পাটালি গুড় তৈরি করি। শীতকালেই শুধু এই কাজ করি। বছরের বাকি সময়টা কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকি। 
রসমেলায় শামিল হয়েছিলেন ফ্রি-ল্যান্স আর্টিস্ট কাবেরি জান্নাত। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, এখানে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ছে। নিজ গ্রামের কথা মনে পড়ছে। পরিবারের সকলে মিলে সকালে উঠে রস খাওয়ার সেই সুন্দর সময়ের কথা মনে পড়ছে। এমনকি শীতের রাতে গাছ থেকে রস চুরি করে খাওয়ার স্মৃতিও ভাসছে মনে। 
জেমরিনা হক, মেহেদি হাসান, ওয়াহিদুজ্জামান টোকন, সানজিদা সুলতানা, ইমরুল চৌধুরীসহ একঝাঁক চিত্রকর শামিল হয়েছিলেন এই মেলায়। রস খেয়ে রসবোধে পরিপূর্ণ হয়ে তারা দিনভর ক্যানভাস রাঙিয়েছেন। রং-তুলির আঁচড়ে শালবনসহ চারপাশের নিসর্গের নান্দনিকতা মেলে ধরেছেন চিত্রপটে।

×