ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১

সাবেক মেয়র বেবীর শত কোটি টাকা লোপাট!

নিজস্ব সংবাদদাতা, সৈয়দপুর

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ৪ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০১:৫০, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

সাবেক মেয়র বেবীর শত কোটি টাকা লোপাট!

ছবি: প্রতিনিধি

সৈয়দপুর পৌরসভার প্রায় শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পলাতক রয়েছেন সাবেক পৌরমেয়র রাফিকা জাহান আক্তার বেবী। তার বিরুদ্ধে বিএনপি অফিস ভাংচুরের অভিযোগে মামলাসহ পৌরসভার বিশাল অংকের টাকা লোপাট করলেও কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০২০ সালে সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন রংপুর বিভাগীয় কমিটির সভাপতি আখতার হোসেন বাদল (৬৫) রংপুর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রকাশ করেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশে ভাগ্য খুলে যায় মরহুম আখতার হোসেন বাদলের স্ত্রী রাফিকার। তিনি সরাসরি শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতে বাগিয়ে নেয় সৈয়দপুর পৌরসভার নির্বাচনে মেয়রের মনোনয়ন।

সাথে ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশনায় প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের সৈয়দপুর উপজেলা শাখাসহ সকল অঙ্গ-সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা ২০২১ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারীর সৈয়দপুরে পৌর নির্বাচনে প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতি করে। তারা ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কক্ষে অবস্থান নিয়ে ভোটার প্রবেশ করা মাত্রই মেয়র প্রার্থীর নৌকা প্রতীকের পাশে বোতামে চাপ দেয়। নিচের কাউন্সিলর প্রতীকগুলোতে ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে দ্বন্দ্ব বাঁধলে প্রশাসন উল্টো অভিযোগকারীদের কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেন। ভোট ডাকাতির এমন দৃশ্য ছিল ওই নির্বাচনে প্রতি ভোট কেন্দ্রের। দিন শেষে রাফিকা আক্তার জাহান বেবীকে ২৮ হাজার ২৭৮টি ভোট পেয়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

তারপরেও ধানের শীষের প্রার্থী মো. রশিদুল হক সরকার ১০ হাজার ৯৭৫টি ভোট, জাতীয় পার্টির সিদ্দিকুল আলম (লাঙ্গল) পেয়েছেন ৯ হাজার ৬২৫টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফেজ মো. নূরুল হুদা (হাতপাখা) এক হাজার ৪৫ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী রবিউল আউয়াল রবি (মোবাইল ফোন) এক হাজার ৮৮২ ভোট পান। তৎকালীন জেলা নির্বাচন অফিসার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা ফজলুল করিম নির্বাচিত ঘোষণা করেন রাফিকা আক্তার জাহান বেবীকে। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রহসনের নির্বাচনে জয় উপহার পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন না বেবী। পৌরসভার মসনদে বসেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। প্রথম শ্রেণীর এ পৌরসভার প্রায় ৫০টি মত আয়ের খাত থেকে উপার্জিত পৌরসভার অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে পকেটস্থ করতেন। পৌরসভার দুইটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন, মাস্টার রোল কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে রেলের দোকানের নাম পরিবর্তন, এলআর ফান্ড ও ব্যাংকে পূর্বের মেয়রের রেখে যাওয়া কয়েক কোটি টাকা উত্তোলন করে তহবিল শূন্য করেন পৌরসভাকে। সাড়ে তিন বছরে এমনিই প্রায় শত কোটি টাকা লোপাট করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে জমি, ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। স্বামীর রেখে যাওয়া শহরের নতুন বাবু পাড়া ও বড়–য়ার গ্রামের বাড়িতে নতুন ডুপ্লেক্স বাড়ি দুটি নির্মাণ করেন। তিনি শুধু অর্থ লোপাটে ক্ষান্ত হননি। বেপরোয়া জীবন যাপনে সেক্স স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ে মুঠো ফোনে। ওই স্ক্যান্ডাল ঢাকতেও কয়েক কোটি ব্যায় করেন তিনি। তার অর্থ লোপাট ও স্ক্যান্ডালে সৈয়দপুরের উন্নয়নে ভাটা পড়ে। শহরের প্রায় আশি ভাগ সড়ক খানা খন্দকে পরিণত হয়। ভোগান্তি পোহাতে হয় শহরবাসিসহ পথচারীদের।

তার এমন অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান পৌরসভার ১৪ জন কাউন্সিলর। তারা সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, স্বারকলিপি প্রদান করেন বিভিন্ন দপ্তরে।

এমনকি নীলফামারী জেলা প্রশাসক, এলজিআরডি উপপরিচালক, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার, এলজিআরডি মন্ত্রণালয় গিয়ে ভিডিও ও আর্থিক কেলেংকারির নথি জমা দেন। সাথে নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নুর, এমপি শাহাজাহান খান, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে গিয়ে ন্যায়বিচারের দাবী করেন প্রতিবাদী কাউন্সিলররা। শুধু শেখ হাসিনার স্নেহভাজন হওয়ায় কোন মন্ত্রী, সচিব বা আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টরা কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলররা জানান, আমরা পৌরসভা রক্ষার স্বার্থে ন্যায় বিচার চেয়ে এমপি আসাদুজ্জামান নুরের পা জড়িয়ে কেঁদেছি। তবে তার পাষাণ হৃদয় গলেনি। আন্দোলনকারীদের দমাতে নীলফামারীর তৎকালীন সংসদ সদস্য, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সকল অঙ্গ-সংগঠনের নেতৃবৃন্দগণ এই রাফিকা জাহানসহ পৌরসভাকে পাহাড়া দিতেন। আন্দোলনকারী ৬ জন কাউন্সিলরকে বাড়িতে ডেকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ঐক্যে ফাটল ধরান। এতে প্রতিবাদী কাউন্সিলরগণের সংখ্যা কমে যাওয়া অভিমানে আর মাঠে নামেননি। তারা ক্ষোভে বিচারের ভার দেন বিধাতার কাছে। ওই সময়ে চলমান ছাত্র-জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে রাফিকাও পালিয়ে যায়। তার আগের দিন তথা ৪ আগস্ট সৈয়দপুর জেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা ও ভাংচুরের অভিযোগে সাবেক পৌর মেয়র ও পৌর মহিলা লীগের সভাপতি রাফিকা জাহান বেবীসহ ৯০ জনকে আসামী করে সৈয়দপুর থানায় মামলা দায়ের হয়। এ মামলার ৪ মাস অতিবাহিত হলেও গ্রেফতার হয়নি সাবেক এ পৌর মেয়র।

এছাড়া এ পৌর শহরে প্রায় আড়াই লাখ অধিবাসীদের জীবনের মানোন্নয়নে ছিনিমিনি খেলা বেবীর বিরুদ্ধে পৌরসভার বিশাল অংকের অর্থ তসরুপ নিয়ে তদন্ত হয়নি। তাহলে সংশ্লিষ্টরা কি, সাবেক ওই মেয়রের সাথে আতাত করেছে? না-কি প্রশাসন তাকে খুঁজে পাচ্ছেনা। এমন নানা প্রশ্ন দগ্ধ করছে শহরবাসিকে।

শহরের ১৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো: ইলিয়াস আলী জানান, ওই মেয়র একটি দোকানের নাম বদল করতে তার লোক দ্বারা ৫ লাখ টাকা নিয়েছে। একই অভিযোগ শহরের ১১ নং ওয়ার্ডের মদীনা মোড় এলাকার ব্যবসায়ী মো: জুয়েল।

তিনি জানান, রেলের বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও নাম পরিবর্তনে প্রায় ১০ লাখ টাকা নেয় সাবেক মেয়র রাফিকা। তাই তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় নেয়া উচিত ওই মেয়রকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পৌরসভার এক কর্মচারী জানান, তিনি টাকার বিনিময়ে বেতন বাড়াতেন। যোগ্যতা না থাকলেও পদের প্রমোশন দিতেন। এতে অনেক কর্মচারী উচ্চ শিক্ষিত হয়েও মাসে মাত্র ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে চাকুরি করছেন। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে সামান্য এই বেতনে মানবেতর জীবন যাপন করছেন প্রায় শতাধিকের উর্ধ্বে মাস্টার রোল কর্মচারী। নীতি বিরুদ্ধ সাবেক ওই মেয়রের সহায়করা এখনও ওই পৌরসভায় কর্মরত থাকায় বৈষম্যের বৃত্তে নিস্পেষিত হলেও দেখার কেউ নেই এ সকল অস্থায়ী কর্মচারীদের।

গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, সাবেক ওই পৌর মেয়র রাফিকা আক্তার জাহান বেবী বর্তমানে রাজশাহীতে অবস্থান করছেন। তার বোনের বাড়ির কাছে। সেখানে একটি ফ্ল্যাট কিনে প্রকাশ্যে ঘুরছেন। এ নিয়ে সৈয়দপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জ মো: ফইম উদ্দিন বলেন, সাবেক পৌর মেয়র রাফিকা জাহান আক্তার বেবীকে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

এ নিয়ে সৈয়দপুর পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, বিষয়গুলো জানতে পেরেছি সত্য। কিন্তু সরকারি ভাবে এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। নির্দেশনা আসলেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এম.কে.

×