টঙ্গী ব্রিজ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ব্যস্তময় সড়কে- প্রতি রাতে একটি করে ছিনতাই হয়
টঙ্গী ব্রিজ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ব্যস্তময় সড়কে- প্রতি রাতে একটি করে ছিনতাই হয়। এমনকি মাঝে মাঝে দিন দুুপুরেও প্রাইভেট কারে বসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকেও ছো মেরে নিয়ে যায়। টহল পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখলেও কিছুই করতে পারে না। মাঝে মাঝে ধাওয়া দেয়। তাতে ওরা কেয়ারও করে না।
শুধু উত্তরা এলাকা নয়, গোটা রাজধানীতেই দৌরাত্ম্য বেড়েছে ছিনতাইকারীদের। ওদের উৎপাত থেকে বাদ যায়নি কঠোর নিরাপত্তার কূটনৈতিক এলাকা গুলশান, বনানী ও বারিধারা পর্যন্ত। এ ছাড়া খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, শাহ আলী ও ইসিবি চত্বরে ছিনতাইকারীদের দাপট চোখে পড়ে। অথচ নগরে সক্রিয় রয়েছে যৌথবাহিনী। আর পুলিশকে তো ওরা তোয়াক্কাই করতে চায় না।
উত্তরা র্যাব-১ ও এপিবিএন অফিসের সামনে দিনদুপুরে হিজড়াবেশী ছিনতাইকারীদের হরহামেশাই চোখে পড়ে। ওদের বেপরোয়া তৎপরতা দেখে পথচারীরা কেবলই অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। রাজধানীর অন্তত ২৯টি পয়েন্টে নিয়মিত ছিনতাকারীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় মানুষজন। তবে ইদানীং পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরাও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন অহরহ।
ভুক্তভোগীদের মতে, দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই ওদের ছিনতাইকারীরা তৎপর হয়। তাদের হামলায় অনেকেই গুরুতর আহত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এ অবস্থায় শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের প্রশ্ন তুলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা নিয়ে। যদিও ছিনতাই রোধে পুলিশ আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় রয়েছে। তবুও ওদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যানেই দেখা যায়Ñ গত ৫ আগস্টের পর থেকেই ওরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস থেকে ছিনতাইকারীরা আরও যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সর্বস্ব কেড়ে নিতে মারমুখী হয়ে উঠছে ছিনতাইকারীরা। গত পাঁচ মাসে ঢাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ গেছে ৯ জনের। আর এ সময়ে ছিনতাই-অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮৬৪ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে মহানগর পুলিশ।
পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সময়ে রাজধানীতেই ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১২৯টি। গত সেপ্টেম্বরে ছিনতাই মামলা হয়েছে ১৭টি, অক্টোবরে ছিনতাই ৩৩টি, নভেম্বরে ছিনতাই ৩৮টি, ও ডিসেম্বরে ছিনতাই মামলা ৩৭। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায় মামলা বেশি হয়েছে। রাজধানীতে গত সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৯টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন বেশ কয়েকজন। আর ৫ আগস্ট থেকে বিগত পাঁচ মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন ৮ জন।
জানা গেছে-শুধু রাজধানীই নয়- সারাদেশেই বেড়েছে ছিনতাই। সে তুলনায় থানায় নথিভুক্ত হচ্ছে না। অধিকাংশ ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করছেন না, কেউ কেউ হারানো বলে জিডি করছেন। যারা শারীরিকভাবে জখম, মারধর কিংবা নিহতের মতো ঘটনা ঘটছে- কেবল সেসব ক্ষেত্রে হচ্ছে মামলা বা অভিযোগপত্র জমা পড়ছে।
এদিকে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে খুইয়েছেন ক্যামেরা, মোবাইল, টাকা আর ব্যাগ। আহত হয়েছেন বেশ ক’জন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, জাগো নিউজের সাংবাদিক-মফিজুল ইসলাম সাদিক, সাংবাদিক পার্থ, বৈশাখীর সিনিয়র রিপোর্টার ও অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠান নির্মাতা জে ইউ জুবায়ের, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মো. নাঈমুর রহমানসহ আরও অন্তত ৭ জন।
জানা গেছে, ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় জিডি ও মামলা হওয়ার চেয়েও বেশি ঘটছে বাস্তবে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা দিতে টালবাহানা করে। যদিও ঢাকার পুলিশ কমিশনার যে কোনো ঘটনায় সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে কেউ থানায় গেলে যেন ফিরে না যান, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে কোনে জিডি নথিভুক্ত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে রেসপন্স করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখনও মামলা না নিয়ে জিডি নিতে আগ্রহী থানা পুলিশ। যেমন- গত ১৮ ডিসেম্বর আদাবরের শেখেরটেক ৬ নম্বর সড়কে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ খোয়ান হাসিব। আদাবর থানায় গিয়ে ঘটনা জানালে থানা পুলিশ তাদের জিডি করার পরামর্শ দেয়। পরে তারা জিডি করে চলে যান। ১১ ডিসেম্বর দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত সংবাদকর্মী আসাদুজ্জামান জানান, তিনি থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। থানা পুলিশ অভিযোগ নিলেও তা নথিভুক্ত করা হয়নি। দারু সাস সালাম থানার ওসি তাকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্ত শেষে মামলা নথিভুক্ত করা হবে।
পুরনো ঢাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়া জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, থানা-পুলিশ কোনো তৎপরতা দেখাবে না, তাই তিনি থানার শরণাপন্ন হননি। অবশ্য পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, থানা-পুলিশ সেই পুরনো অভ্যাসেই রয়েছে। যার থানায় মামলা বেশি তার জবাবদিহি বেশি করতে হয় বলে ছিনতাই বা চুরির ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আগেও এমন ছিল। রাতারাতি তা পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কথা নয়। থানা-পুলিশের উচিত প্রতিটি ধর্তব্য অপরাধের ক্ষেত্রেই মামলা নথিভুক্ত করা।
ছিনতাইকারীদের এত বেপরোয়া ও ভয়ংকর হয়ে ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান ভিন্ন কথা। তিনি বলেন- আন্দোলনের আগে যারা ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগে বা ক্রাইম জোনে দায়িত্বরত ছিল- তারা ঢাকার অপরাধ জোন এবং ক্রাইম ট্রেন্ড সম্পর্কে জানতো। এ জন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের বেগ পেতে হতো কম। কিন্তু নতুন দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা বা সদস্যদের অপরাধের ধরন ও অপরাধীদের শনাক্ত করতে একটু সময় লাগছে। এ ছাড়া শুরুর দিকে পেট্রোলিং কম ছিল বলে অপরাধ বেড়েছিল। ক্রমান্বয়ে পেট্রোলিং বাড়ানো হচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে পুলিশ এ ক্ষেত্রে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠছে। শীঘ্রই ছিনতাই কমে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার প্রধান (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে শুধু ছিনতাকারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এ অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার আসামি হিসেবে ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ৯১, নভেম্বরে ১৪৮ ও সর্বশেষ ডিসেম্বরে রেকর্ড ৫৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তার পরও পুলিশ আগের তুলনায় সার্বক্ষণিক ডিউটি সবার চোখে পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ, জনবহুল ও ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় ডিবি পুলিশ কাজ করছে। আবাসিক এলাকার অলিগলিতে টহলে থাকছে থানা পুলিশ। কোথাও কোনো ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ছুটে যাচ্ছে পুলিশ। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে।