আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান
চাঁদপুরে দেশের বহুল আলোচিত সার বোঝাই কার্গো জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় আকাশ ম-ল ওরফে ইরফানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকা থেকে র্যাব-১১ এর একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে বুধবার দুপুরে কুমিল্লায় নিয়ে আসে। এরপর বিকেলে র্যাব চাঁদপুর নৌ পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করে। সন্ধ্যায় চাঁদপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইরফানের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বেতন আটকে রাখাসহ নানান বৈষম্য এবং ওই জাহাজের মাস্টারের দুর্ব্যবহার থেকে ক্ষোভের কারণে জাহাজের লস্কর ইরফান প্রথমে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যার সাক্ষী না রাখতে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরও ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ইরফান রান্না করা তরকারির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে দেয়। রাতের খাবার খেয়ে তারা সকলে অচেতন হয়ে পড়ে।
র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের উপঅধিনায়ক মেজর সাকিব হোসেন গতকাল বুধবার দুপুরে র্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লা কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। এ সময় র্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লা কার্যালয়ের এএসপি মিঠুনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
র্যাব জানায়, গত ২২ ডিসেম্বর সকালে এমভি-আল বাখেরা জাহাজে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম হতে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরের মাঝিরচর এলাকায় ওই জাহাজে ৭ জনকে হত্যা ও একজনকে গুরুতর জখম করার ঘটনা ঘটে। খুন হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া (৬০), গ্রিজার মো. সজিবুল ইসলাম (২৯), লস্কর মাজেদুল ইসলাম (১৭), শেখ সবুজ (৩৫), আমিনুর মুন্সী (৪১), ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন (৪০) ও বাবুর্চি রানা কাজী (৩৮)। এ ছাড়া আহত ব্যক্তি হলেন- সুকানি জুয়েল (২৮)।
এ ঘটনার পরদিন ওই জাহাজের মালিক মাহবুব মোর্শেদ বাদী হয়ে চাঁদপুরের হাইমচর থানায় মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি প্রথমে ডাকাতি বলে ধারণা করা হয়। এর পর থেকে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তারে র্যাবের অভিযান শুরু হয়। র্যাব তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার করে গত মঙ্গলবার রাতে বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জাহাজের লস্কর আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেপ্তার করে। সে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের জগদীশ মণ্ডলের ছেলে। এ সময় তার নিকট হতে ১টি হ্যান্ড গ্লাভস, ১টি লোটো ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত ৫টি ও তার ২টিসহ মোট ৭টি মোবাইল এবং রক্তমাখা একটি জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের উপঅধিনায়ক মেজর সাকিব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ইরফান জানিয়েছে- সে প্রায় ৮ মাস ধরে ওই জাহাজে চাকরি করে আসছে। জাহাজের কর্মচারীরা বেতন-বোনাস ও ছুটি সময়মতো পেত না। বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে মাস্টার গোলাম কিবরিয়া একাই ভোগ করত, বিনা কারণে কর্মচারীদের গালমন্দসহ জাহাজ থেকে নামিয়ে দিত। বকেয়া বেতন দিত না। এ বিষয়ে কেউ মাস্টারের ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না।
এসব কারণে মাস্টারের প্রতি তার প্রচ- ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৮ ডিসেম্বর ৩ পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রাখে এবং ঘটনার দিন রাতের খাবারের রান্না করা তরকারির মধ্যে ওই ৩ পাতার ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। ওই রাতে ইরফান ও আহত জুয়েল ছাড়া সবাই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে সাহারা বিকন এলাকায় আরও ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে সুকানি জুয়েল এবং গ্রেপ্তার ইরফান তাদের জাহাজটি নোঙ্গর করে এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত সাড়ে ৩টায় প্রথমে মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
এ ঘটনা অন্যরা জেনে গেলে ধরা পড়ার ভয়ে কোনো সাক্ষী না রাখতে সে অন্যদের কুপিয়ে হত্যা করে এবং জুয়েলকে আহত করে মৃত ভেবে পরবর্তীতে সে নিজে গন্তব্যের উদ্দেশে ভোর সাড়ে ৫টায় জাহাজ ছাড়ে এবং একপর্যায়ে মাঝিরচর এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে বাজার করার কথা বলে একটি চলন্ত ট্রলারে উঠে ইরফান পালিয়ে গিয়ে বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকায় আত্মগোপন করে। এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের উপঅধিনায়ক আরও জানান, আহত জুয়েল চিকিৎসাধীন আছে।
এ হত্যাকা-ের সঙ্গে সে জড়িত কি না এ মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত ইরফান এসব হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার কথা শিকার করে ঘটনার জন্য এখন অনুশোচনা প্রকাশ করছে। প্রেস ব্রিফিং শেষে গ্রেপ্তারকৃত ইরফানকে চাঁদপুরের হাইমচর থানায় প্রেরণ করা হয়েছে।
ইরফান ৭ দিনের রিমান্ডে ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, চাঁদপুর থেকে জানান, জাহাজে ৭ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামি আকাশ ম-ল ইরফানের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
বুধবার সন্ধ্যায় চাঁদপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্তকারী কর্মকর্তা নৌ পুলিশের পুলিশ পরিদর্শক মো. কালাম খান আসামির ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালতের বিচারক মুহাম্মদ ফারহান সাদিক ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) শরীফ মাহমুদ সায়েম এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
গ্রেপ্তার আকাশ ম-ল (২৫) বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট এলাকার জগদীশ ম-লের ছেলে।
বিকেলে র্যাব-১১ এর একটি দল আসামি আকাশ ম-লকে নৌ পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হস্তান্তর করেন। সেখান থেকে তাকে কঠোর নিরাপত্তায় র্যাব, নৌ পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ আদালতে নিয়ে যায়। আদালতে নৌ পুলিশ পরিদর্শক ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে হাজির করেন। এর পর আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে বিচারক ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শরীফ মাহমুদ সায়েম, মাসুদ প্রধানীয়া, ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম ও মো. শাহজাহান খান। তবে আসামি পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না।
জাহাজে হতাহতের ঘটনা তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদা কমিটি করা হয়েছে। আর জাহাজ মালিক মাহবুব মোর্শেদ মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় ৩৯৬/৩৯৭ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন জাহাজের মালিক মাহাবুব মোর্শেদ। মামলা নম্বর (১৭ / ১৬৬)।
ফরিদপুরের নিজ বাড়িতে মামা-ভাগ্নের দাফন সম্পন্ন ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, ফরিদপুর থেকে জানান, এমভি আল-বাখেরা নামের সারবাহী জাহাজে সাতজন নিহতের মধ্যে গোলাম কিবরিয়া (৬৫) ও সবুজ শেখের (২৬) মরদেহ নিয়ে চাঁদপুর থেকে ফরিদপুরের বাড়িতে পৌঁছায় মঙ্গলবার রাত ১০টায়। সম্পর্কে তারা মামা-ভাগ্নে। মঙ্গলবার রাতেই স্থানীয় গফুর মাতুব্বরের গোরস্থানে নিহত মামা-ভাগ্নের মরদেহ দাফন করা হয়।
এর আগে একই দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে চাঁদপুর থেকে দুইজনের মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা দেন নিহত সবুজের ভাই মিজানুর রহমানসহ অন্যরা। তারা ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নের জোয়ারের মোড় এলাকার বাসিন্দা। গোলাম কিবরিয়া সদরের জোয়ারের মোড়ের মৃত আনিসুর রহমানের ছেলে। এ জেলার নিহত অপরজন সবুজ শেখ গোলাম কিবরিয়ার ভাগ্নে। গোলাম কিবরিয়া এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা এবং সবুজ ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে চতুর্থ ও অবিবাহিত ছিল।