ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-খুলনা ঢাকা-বেনাপোল ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-খুলনা ঢাকা-বেনাপোল ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন

উদ্বোধনী যাত্রায় ঢাকা থেকে বেনাপোল যাওয়ার উদ্দেশে কমলাপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সুসজ্জিত ‘রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস’ (বাঁয়ে)। অপেক্ষায় যাত্রীরা

পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা ও বেনাপোল রুটের দুটি নতুন ট্রেন যাত্রার মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত চালু হলো নতুন রেলপথ পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পটি। ১৬৯ কিলোমিটার এই রেলপথ ব্যবহার করে মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে খুলনা ও যশোরে যাতায়াত করতে পারছেন রেলযাত্রীরা। কম সময়ে ও কম ভাড়া ট্রেন ভ্রমণ করতে পারায় আনন্দ ও স্বস্তি প্রকাশ করেন যাত্রীরা। 
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে ঢাকা-খুলনা রুটে ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ এবং ঢাকা-বেনাপোল রুটে ‘রূপসী বাংলা’ এক্সপ্রেস নামের দুটি আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিসের উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক ও রেল উপদেষ্টা মুহাম্মাদ ফাওজুল কবির খান। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম, রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে রেলওয়ে উপদেষ্টা বলেন, আজ (মঙ্গলবার) আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। পদ্মা রেল সেতু সংযোগের মাধ্যমে খুলনা এবং ঢাকার মধ্যে একটা দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে নতুন যে ট্রেন চালু হলো এটার যেন সময়ানুবর্তিতা বজায় থাকে। ট্রেনে যেসব সুবিধা যেমন কোচগুলো যেন পরিষ্কার করা হয় এগুলো যেন ব্যবহারযোগ্য থাকে এবং যাত্রীসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির বলেন, ‘সবাই বাড়ির পাশে ট্রেন স্টেশন চায়। সবাই আশা করেন যে রেলগাড়িটি তাদের বাড়ির পাশে থামবে। আবার তারা এটাও চান যে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবেন। এটা সম্ভব না। আপনি যতই স্টপেজের সংখ্যা বাড়াবেন যাতায়াতের সময় বাড়বে। আপনি অন্য একটা যানবাহনে রেলস্টেশনে যাবেন। এটা একটা সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্টেশন। যেখানে যাত্রী বেশি হবে, রাজস্ব বেশি পাওয়া যাবে, সেখানেই গাড়ি থামবে।
রেলের নানান রকম সংকট আছে উল্লেখ রেল উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা অনেকেই অসন্তোষ ব্যক্ত করে থাকেন, কিন্তু আপনাদের জানতে হবে রেল কেন আপনাদের প্রকৃত সুবিধা দিতে পারে না। আমাদের লোকোমেটিভের সংকট আছে, কোচের সংকট আছে, ওয়াগন ও লোকবলের সংকট আছে। রেলের আজ যে অবস্থা, এ অবস্থায় আসার একটি বড় কারণ হচ্ছে অপব্যয়। আমাদের যে কোনো প্রকল্পের ব্যয় ভারত কিংবা আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা যত্রতত্র স্টেশন স্থাপন করেছি।

যত্রতত্র রেললাইনের বিস্তার করা হয়েছে কিন্তু লোকোমোটিভ আছে কিনা, জনবল আছে কি না সেগুলোর ব্যবস্থা না করেই এগুলোর বিস্তার করা হয়েছে।’ তাই রেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য যারা কাজ করেন সবার প্রতি অনুরোধ জানাব কীভাবে রেলের খরচ কমানো যায়। ব্যয় যদি কমানো যায় তাহলে রেল সেবার যে প্রত্যাশা সেটি আমরা পূরণ করতে পারব বলে জানান তিনি।
চার ঘণ্টায় ভ্রমণে স্বস্তি প্রকাশ ট্রেন যাত্রীদের ॥
মাত্র চার ঘণ্টায় খুলনা ও বেনাপোল থেকে ঢাকায় পৌঁছতে পেরে আনন্দ ও স্বস্তি প্রকাশ করেন ট্রেন যাত্রীরা। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ছেড়ে আসে। এটি ঢাকায় পৌঁছায় সকাল ১০টা। একইভাবে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বেনাপোলের উদ্দেশে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি। এটি বিকেল সোয়া ৩টায় বেনাপোল স্টেশনে পৌঁছায়। মাত্র চার ঘণ্টায় খুলনা থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে বেনাপোল রুটে যাতায়াত করতে পারায় স্বস্তি প্রকাশ করেন ট্রেন যাত্রীরা।
শেখ মামুন রশিদ নামের যশোরের এক যাত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন রেললাইন চালু হওয়ায় যশোরবাসীর জন্য খুবই উপকার হয়েছে। মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে যশোরে যাতায়াত করা যাচ্ছে। ট্রেনের ব্যবস্থাপনা অনেক ভলো লাগল।’ মঙ্গলবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে বিকেল সোয়া ৩টায় তারা যশোরের বেনাপোল স্টেশনে পৌঁছায় বলে জানান তিনি।  
আমাদের খুলনা অফিস জানায়, এই ট্রেন চালুর মধ্য দিয়ে খুলনা-নড়াইল ও ফরিদপুরের মানুষের রাজধানীর সঙ্গে রেল পথে যোগাযোগ আরও সুগম হলো। খুলনা-ঢাকা রুটে এখন থেকে তিনটি রুট ব্যবহার করে চার জোড়া ট্রেন চলাচল করবে। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে জাহানাবাদ এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। এর ফলে পদ্মা সেতু হয়ে নতুন রেলপথে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার আগে যা ছিল ৪৩০ কিলোমিটার।

আগে যেখানে যমুনা সেতু হয়ে যাত্রীদের যাতায়াতে সময় লাগে সাড়ে ৯ ঘণ্টা নতুন রুটে সেই যাত্রা শেষ করতে সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। নতুন এই রেল চালুর মধ্য দিয়ে নড়াইল ও ভাঙ্গারবাসী যুক্ত হয়েছে রেল নেটওয়ার্কে যা যাত্রাপথের সময় ও ভোগান্তি কমাবে, পাশপাশি আর্থিক সাশ্রয়ও হবে বলে জানান যাত্রীরা। 
ব্যবসায়ী হারুন শেখ নামের এক যাত্রী বলেন, ‘খুলনা থেকে ভাঙ্গা হয়ে জাহানাবাদ এক্সপ্রেসের উদ্বোধনী ট্রেনে ঢাকায় যাওয়ার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। ইতিহাসের যাত্রী হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। সত্যি এ এক অন্যরকম অনুভূতি।’ ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়ানো হলে হলে দুর্ভোগ আরও কমবে বলে জানান তিনি।
নিজস্ব সংবাদদাতা, নড়াইল জানান, খুলনা থেকে নড়াইল হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকার পথে যুক্ত হয়েছে নতুন ট্রেন ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। ৭টা ৩৫ মিনিটে ট্রেনটি নড়াইল স্টেশনে এসে পৌঁছালে সবার মাঝে আনন্দ-উৎসব সৃষ্টি হয়। তবে ট্রেন আসার আগেই ভোর থেকে যাত্রীসহ উৎসুক জনতা ব্যাপক ভিড় করেন নতুন রেলযাত্রা দেখতে। এই রেলযাত্রার মধ্য দিয়ে নড়াইল থেকে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। যাত্রী সাধারণের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে বলে জানান স্থানীয়রা।
ট্রেন বাড়ানোর দাবি যশোরবাসীর ॥
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর জানান, ‘বিক্ষোভ আর কালো পতাকা প্রদর্শন করে ঢাকা-বেনাপোল রুটের রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসকে বরণ করল যশোরবাসী। মঙ্গলবার বিকেল থেকে যশোর জংশনে সমাবেশ এবং সন্ধ্যায় ঢাকাগামী রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে কালো পতাকা বেঁধে কর্মসূচি সমাপ্ত করা হয়। মাত্র একটি ট্রেন দিয়ে যশোর ও খুলনাবাসীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টার প্রতিবাদে উদ্বোধনী দিনে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি গ্রহণ করে বৃহত্তর যশোর জেলা রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি। 
তাদের ছয় দফায় দাবিগুলো হলো, দ্রুততম সময়ে যশোর-ঢাকা-পদ্মা সেতু লিংক প্রোজেক্টে বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ঢাকা রুটে ২টি ট্রেন চালুসহ দর্শনা-যশোর-নড়াইল-ঢাকা রুটে ২টি ট্রেন চালু, নিজ শহর থেকে প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করার জন্য ট্রেনের সময়সূচি তৈরি করা, আন্তঃনগর ট্রেনে সুলভ বগী যুক্ত করা, ট্রেনের ভাড়া বাস ভাড়া থেকে কম রাখা, ট্রেনের টিকিট প্রাপ্তির সহজ পদ্ধতি চালু করা, সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা। 
নতুন ট্রেন ভাড়া ॥ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু লিংক প্রকল্পে ঢাকা-নড়াইল-খুলনা ও ঢাকা-নড়াইল-যশোর রুটে মঙ্গলবার চালু হয়েছে দুটি ট্রেন। এর মধ্যে ঢাকা-খুলনা রুটে ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ এবং ঢাকা-বেনাপোল রুটে ‘রূপসী বাংলা’ এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলাচল করবে। খুলনার স্টেশন ছেড়ে ট্রেনটি নওয়াপাড়া, সিংগিয়া, নড়াইল, লোহাগড়া, কাশিয়ানী, ভাঙ্গা স্টেশন হয়ে ঢাকায় পৌঁছাবে। খুলনা থেকে রেলপথে যমুনা সেতু হয়ে ঢাকার দূরত্ব ৩৭৬ কিলোমিটার। নতুন এ রেলপথ নির্মাণে যাতায়াতে দূরত্ব কমেছে ১৭৭ কিলোমিটার।
খুলনা-ঢাকা রুটে তিনটি ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে দুটি আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও চিত্রা এক্সপ্রেস, আর একটি নকশিকাঁথা কমিউটার ট্রেন। এতে খুলনা থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টারও বেশি। ফলে চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। নতুন জাহানাবাদ এক্সপ্রেস চালু হওয়ায় মাত্র পৌনে চার ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছাবেন যাত্রীরা। ট্রেনে খুলনা থেকে ঢাকায় যাওয়ার সর্বনি¤œ ৪৪৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৩৩০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যা সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেসের থেকে কম। খুলনা থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় ও অর্থ কম লাগায় খুশি যাত্রীরা। জাহানাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনে মোট ৭৬৮টি সিট রয়েছে। 
এ ছাড়াও অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ টিকিট বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে। কেউ দাঁড়িয়ে যেতে চাইলে এই টিকিট ক্রয় করতে পারবেন। ঢাকা-খুলনা ঢাকা রুটে একজন যাত্রীকে একক যাত্রায় ভাড়া দিতে হতো শোভন চেয়ারে ৬৩০ টাকা ও স্নিগ্ধা শ্রেণিতে ১২০৮ টাকা। 
বর্তমানে একই গন্তব্যে যেতে একজন যাত্রীকে ভাড়া দিতে হবে শোভন চেয়ারে ৪৪৫ টাকা ও স্নিগ্ধা শ্রেণিতে ৮৫১ টাকা অর্থাৎ শ্রেণিভেদে একই গন্তব্যে ভাড়া কমছে যথাক্রমে ১৮৫ ও ৩৫৭ টাকা।

×