মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে খুলনা
ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বেনাপোল লাইনে দুটি নতুন ট্রেন চালুর মাধ্যমে আজ মঙ্গলবার ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হচ্ছে। নতুন এই রেলপথ ব্যবহার করে মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে খুলনা এবং ঢাকা থেকে বেনাপোলে যাতায়াত করতে পারবে ট্রেন যাত্রীরা।
তাই ঢাকা-খুলনা রেল পথে ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ এবং ঢাকা-বেনাপোল লাইনে ‘রূপসী বাংলা’ নামের দুটি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে রেলওয়ে। যা আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে নতুন এই ট্রেন সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন আন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক ও রেল উপদেষ্টা মুহাম্মাদ ফাওজুল কবির খান।
এই ট্রেন সার্ভিস চালুর মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার নতুন রেলপথ পুরোপুরো চালু হবে। এর আগে গত বছর ১ নভেম্বর ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত চালু করা হয়। এই নতুন রেলপথ নির্মাণের ফলে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা নতুন করে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৭ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।
অবশ্য শুরুতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যয় সাশ্রয় করে ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা বাঁচানো হয়েছে। আর ৬২২ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে ডিপিপি দ্বিতীয়বার সংশোধন করে। ফলে বর্তমান সরকার এই প্রকল্প থেকে ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে বলে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাইজুল কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি জিটুজি ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় কিছু কাটছাঁট করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তবে প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়টি চায়না রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে।’
ঢাকা-খুলনা ট্রেনে চার ঘণ্টায় ॥ রেলওয়ে সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু হয়ে নতুন রেলপথ নির্মাণের ফলে ট্রেনে যাতায়াতে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব ২১২ কিলোমিটার কমে গেছে। এই পথে ঢাকা থেকে খুলনায় যাওয়া যাবে পৌনে চার ঘণ্টায়। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু হয়ে যাতায়াতে সময় লাগে সাড়ে ৯ ঘণ্টা। ঢাকা-খুলনা পথে ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ এবং ঢাকা-বেনাপোল পথে ‘রূপসী বাংলা’ নতুন রেলপথ দিয়ে চলাচল করবে। এ ট্রেন দুটির সাপ্তাহিক বন্ধ সোমবার। বাকি ছয় দিন চলাচল করবে। দিনে দুবার ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বেনাপোল পথে চলাচল করবে ট্রেন দুটি।
রেলের দেওয়া সময়সূচি অনুসারে, জাহানাবাদ এক্সপ্রেস খুলনা থেকে ছাড়বে সকাল ছয়টায়। ট্রেনটির ঢাকায় পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে আবার ট্রেনটি ছেড়ে যাবে রাত আটটায়। খুলনায় পৌঁছানোর কথা ১১টা ৪০ মিনিটে। অন্যদিকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে ছাড়বে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে। ট্রেনটির যশোরের বেনাপোল পৌঁছানোর কথা বেলা ২টা ৩০ মিনিটে। ফিরতি যাত্রায় যশোর থেকে ট্রেনটি ছাড়বে বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে। আর ঢাকায় পৌঁছানোর কথা সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে।
বর্তমানে ঢাকা থেকে খুলনার পথে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি চলাচল করে। এর মধ্যে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া হয়ে খুলনায় যাচ্ছে। এতে প্রায় আট ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। অন্যদিকে চিত্রা এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু হয়েই চলাচল করছে। এই ট্রেনের সময় লাগে সাড়ে ৯ ঘণ্টা। এর বাইরে বেনাপোল এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া হয়ে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত চলাচল করে। এতে সময় লাগছে সাড়ে ৭ ঘণ্টা।
গত বছর পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেন চলাচল উদ্বোধনের সময় ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নতুন লাইন চালু হয়। সে জন্য ঢাকা থেকে ভাঙ্গা, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া হয়ে খুলনার পথে ট্রেন চলাচল করে। এখন যশোর পর্যন্ত পুরোটা নতুন রেলপথ চালু হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস নতুন পথে চালু করার উদ্যোগ নিলে কুষ্টিয়ার স্থানীয় জনগণ বাধা দেন। আন্দোলনেরও হুমকি দেন।
তাই রেল কর্তৃপক্ষ সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস চলাচলের পথ ঠিক রেখে কাশিয়ানী হয়ে নতুন রেলপথ দিয়ে জাহানাবাদ ও রূপসী বাংলা নামের নতুন দুটি আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়। ভবিষ্যতে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ার পথে নতুন একটি ট্রেন চালু করা হবে। তখন সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি নতুন পথ দিয়ে চলাচল করবে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, পুরনো ট্রেনগুলো আগের পথেই চলাচল করবে। ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ ও ‘রূপসী বাংলা’ এক্সপ্রেস নতুন এই দুটি ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। নতুন রেলপথ দিয়ে খুলনা-যশোরে যেতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা সময় বেচে যাবে।’ ভবিষ্যতে যাত্রী চাহিদা ও ইঞ্জিন-কোচের প্রাপ্যতা সাপেক্ষে ট্রেন আরও বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।
বুড়িমারী পর্যন্ত চলবে বুড়িমারী এক্সপ্রেস ॥ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা-লালমনিরহাট-ঢাকা লাইনে চলাচল করা বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের রুট বুড়িমারী পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। যাত্রীসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ও বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের রেকের লিঙ্ক সমন্বয় করে বুড়িমারী পর্যন্ত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সোমবার বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-পরিচালক (টিটি) মো. মিহরাবুর রশিদ খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপককে পাঠানো ওই চিঠিতে ট্রেনটি বুড়িমারী পর্যন্ত পরিচালনার জন্য টাইম টেকি ৫৪তে নতুন সময়সূচি অন্তর্ভুক্তকরণ এবং বুড়িমারী স্টেশনে ট্রেন পরিচালনার প্রয়োজনীয় সুবিধাদি যেমন ওয়াটার হাইড্রান্ট, প্ল্যাটফরম সংস্কারসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করা আবশ্যক বলেও জানানো হয়। এমতাবস্থায় বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনকে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ও বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের রেকের লিঙ্ক সমন্বয় করে বুড়িমারী পর্যন্ত পরিচালনার লক্ষ্যে আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়।
দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে যাওয়ায় খুশি এলাকাবাসী। এদিকে নড়াইলের ওপর দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচলে উন্মুখ হয়ে আছেন নড়াইলবাসী। কারণ নড়াইল এই প্রথম রেল সংযোগের আওতায় আসল।
ঢাকা থেকে যশোর ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেললাইন নির্মাণ করেছেন চীনের ‘চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লি. নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় ধাপের ভাঙ্গা-নড়াইল-যশোর অংশের সকল স্টেশন নির্মাণসহ রেল লাইনের কাজ শেষে ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েকবার ট্রেন চালানো হয়েছে এই রুটে। এই রুটের প্রথম ধাপে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলসেবা চালু হয়েছে গত বছর। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোরের রূপদিয়ায় মিশেছে এই রেলপথ। নড়াইলের লোহাগড়ার নারানদিয়া ও নড়াইল পৌর এলাকার দুর্গাপুরে দুটি রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
দেশের বৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল, বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া ও শিল্পাঞ্চল খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই রেললাইন। এ রেল লাইনটি চালু হলে সাধারণ মানুষের চলাচলের সুবিধার পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে ব্যবসা বাণিজ্য। নতুন রেলপথ চালুর সংবাদে খুশি এলাকাবাসী। এই রেললাইন চালুর সুফল পৌঁছে যাবে এই এলাকার মানুষের কাছেÑ এটিই সকলের প্রত্যাশা।
নড়াইল চিত্রা রিসোর্টের মালিক তরিকুল ইসলাম অনিক বলেন, নতুন এ রুটে ট্রেন চলাচল নড়াইলসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসছে এই ট্রেন লাইন। নানাভাবে উপকৃত হবে এখানকার মানুষ।
এ বিষয়ে নড়াইলের স্টেশন মাস্টার উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, আজ মঙ্গলবার থেকে বাণিজ্যিকভাবে অত্যাধুনিক এ রুটে জাহানাবাদ ও রূপসী বাংলা নামে দুটি ট্রেন চলাচল করবে। ইতোমধ্যে নড়াইল অংশের অধিকাংশ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। নড়াইল ও লোহাগড়া স্টেশনে ৯ জন জনবল নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকজনকে নিয়োগের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে।