ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

চট্টগ্রামে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়

‘সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে চিকিৎসক হিসেবে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে’

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥

প্রকাশিত: ১৭:৫৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

‘সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে চিকিৎসক হিসেবে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে’

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তখন চিকিৎসক হিসেবে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। যে যার পেশার প্রতি সৎ থাকলে দেশটা সুন্দর হবে। নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব ঠিকমত পালন করলে এবং আইন মান্য করার মানসিকতা থাকলে বারবার বিপ্লবের দরকার হবে না। গত ফ্যাসিবাদী আমলে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কালচারকে নষ্ট করা হয়েছে, ভবিষ্যতে সেগুলো যাতে আর না হয়। সোমবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে চট্টগ্রাম জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. আইয়ুব মিয়া বলেন, রাষ্ট্রের নাগরিকদের সকলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় একটা নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার জন্য জনপ্রশাসনের একটা বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু অতীতে গত ফ্যাসিবাদী আমলে আমরা দেখেছি এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভঙ্গুর করা হয়েছে। ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কালচারকে নষ্ট করা হয়েছে।  চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সকে নষ্ট করা হয়েছে। সেটা যেন আর না হয়। যা সাম্য, মানুষের যে সামাজিক সুবিচার, প্রত্যেকের সমান অধিকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু জনপ্রশাসনের। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যদি অন্যায়ভাবে হয়, অন্য আরেকজনের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়। আসলে কাজটি যেমন রাষ্ট্রের সরকারের জনপ্রশাসনের তেমনি বড় কাজটা আসলে নাগরিকদের। এই নাগরিকদের কাজটি করার জন্য সামাজিক আন্দোলন দরকার।

২৪এর জুলাই-আগস্টে যে আন্দোলন হয়েছে এটা কিন্তু নাগরিকদের অংশগ্রহণের কারণেই বড় ধরনের বিপ্লব ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, এটা কিন্তু বিশেষ কোনো শ্রেণি করতে পারেননি। ফলে জনগণের সম্মিলিত শক্তি হল সবচেয়ে বড় শক্তি। সম্মিলিত শক্তি যদি অভিপ্রায় নেয় আমরা আমাদের সমাজকে রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে পুর্নবিন্নস্তভাবে করে গঠন করব, তাহলে নিশ্চয় আমরা এদেশের জন্য একটা সুন্দর সিস্টেম চালু করতে সক্ষম হব।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মেহেদী হাসান বলেন, অনেকে বলে আমরা বয়স অনুসারে পাকা পাকা কথা বলছি। অনেকের লাগে আর কি, ফাটে। যাদের ফাটে বা লাগে তাদের উদ্দেশ্যে কথা হচ্ছে, আমরা যদি বেয়াদব না হতাম শেখ হাসিনাকে নামানো যাইতো না, বুঝছেন। আজকে অনেক সুন্দর কথা আসতেছে। একজন বলতেছিলেন যে, সাব রেজিস্ট্রার অফিসার সপ্তাহে দুই দিন অফিস করেন। আমাদের কমিশনের পক্ষ থেকে এটাই বলার, আমাদের জনপ্রশাসন সচিব একটা সভায় এ বলেছিলেন যে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে ২ দিন আসে, যেদিন আসবে সেদিন তাকে তালা মেরে বসে থাকবেন। তারপর অফিস করতে দিবেন। 

তিনি আরও বলেন, সবকিছু মিলিয়ে যে চিন্তাভাবনা করার সময় ও সুযোগ সেটা কমিশন হয়ত পাচ্ছে না। আমি ব্যক্তিভাবে এটা ফিল করেছি। দ্বিতীয় বিষয় হল, আমাদের প্রধান কার্যক্রম কোনটা হবে। ১৬ বছরের যে ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি, তারপর এই সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। এই সংস্কার কমিশনের প্রধান কাজ কোনটা হইতে পারে? প্রধান কাজ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রশাসনে যে পলিটিক্যাল ইন্টারফেয়ারেন্স, এটাকে আলাদা করা। গণতান্ত্রিক দেশে সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। যেখানে সব ক্ষমতার উৎস জনগণ সেখানে সর্বোচ্চ জবাবদিহিতার মালিক হচ্ছে জনগণ। আমরা কি করতে পারি? আমরা যেখানে যে ঘুষ নিতে চাচ্ছে, সেখানে নগদ প্রতিহত করতে হবে। যে রাজনীতিবিদ তার কমিটমেন্টের বাইরে কাজ করবে তাকে নগদ প্রতিহত করতে হবে। 

এ প্রতিনিধি বলেন, গত ১৬ বছর আমাদেরকে একটা কালচারের মধ্যে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছে। সে কালচারটা কি? প্রত্যেক প্রত্যেকের আখের গোছানোর চেষ্টা কর। আপনারা পত্রিকাগুলো দেখেন, সংস্কার কমিশন কাজ করতেছে। ক্যাডার ক্যাডার মারামারি লেগে গেছে। যে ভাই আমাদের ক্ষমতা এতটুকু, ওদের ক্ষমতা এতটুকু। কিন্তু যে আমলাদের সার্ভিসটা কিভাবে আরও সহজে জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে, একটা টিমওয়ার্কের মাধ্যমে।  সেই টিমওয়ার্কটা কেমন হবে, এটা নিয়ে কোন আলাপ নাই। এটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। এই যে একটা আত্মকেন্দ্রীক চিন্তাভাবনা, এটা শুধুমাত্র প্রশাসনিক না, শুধুমাত্র রাজনীতিদ না একেবারে রুট লেভেলে যে একজন দিনমজুর তার পর্যন্ত চলে গেছে। এখন আপনি যদি বলেন, ফ্যাসিবাদকে আমরা সবাই মিলে নামাই দিছি। আমার প্রশ্ন যে ১৬ বছর কেন লাগল? আমরা আগে কেন এটার প্রতিবাদ করতে পারলাম না? একটাই কারণ, যতক্ষণ না আমার ঘাড়ের উপর আইসা পড়ছে, যতক্ষণ না আমার সন্তান, আমার মা-বোন এফেক্টেড না হচ্ছে ততক্ষণ আমি কিছু বলি নাই।

মেহেদী হাসান বলেন, সরকারি অফিস থেকে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তার চাকরিজীবন শেষ করে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলবেন, সে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরতেছে। সে যে এই কালচারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার কথাটা আমি বলতেছি কিনা। আমি তার কথা বলতেছি কিনা সেটা দেখতে হবে। সরকারি অফিসে ঘুষ কারা দেয়? এই কালচারটা কারা তৈরি করে? যাদের পকেটে টাকা আছে তারা। সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণি। এদের কারণে যাদের টাকা নেই তাদের উপর প্রভাব পড়ে। আমাদের সাইকোলজিক্যাল একটা চেঞ্জ দরকার। বিপ্লব হয়েছে ঠিক আছে,  কিন্তু যারা বিপ্লবী তাদের মধ্যেও একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ সালে কি জন্য? সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের জন্য। বার বার বিপ্লব কেন হয়? আমাদের এই তিনটা জিনিস হয় না দেখে। আমাদের এই জায়গাগুলো চিন্তা করতে হবে। 

হাসিনা একজন ব্যক্তি। ফ্যাসিবাদ একটা আইডিওলজি। এগুলো যুগে যুগে একজিস্ট করতেছে এবং করবে। এগুলো যাতে আবার না আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাসটেইন করবে না। একটা গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলই শাসন করবে উল্লেখ করে এ প্রতিনিধি বলেন, এটাই নিয়ম এবং এটাই হবে। কিন্তু ওই পলিটিক্যাল পার্টি, যেই আসুক যেন ডেমোক্রেটিক মাইন্ড সেটের উপর থাকে। যাতে জনসম্পৃক্ত থাকে। যে লোকটা আইন, প্রশাসন, ক্যাডার বুঝে না সেই লোকটা যেন সরকারি অফিসে সেবাটা সহজে পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যেন বৈষম্য না হয়। মসজিদে যখন মানুষ যায়, তখন কি মানুষ বৈষম্য করে? যে আমার টাকা বেশি আছে দেখে হচ্ছে আমি সামনের কাতারে নামাজ পড়ব? যে লোকটা ভ্যানগাড়ি চালায় সে হচ্ছে পিছনে দাঁড়াবে? 

এরকম ক্লাসিফিকেশন আছে কিনা জানতে চেয়ে মেহেদী হাসান বলেন, প্রত্যেকটা সরকারি অফিস মসজিদের মত হইতে হবে। সেখানে কোন ক্লাসিফিকেশন থাকবে না সেবার ক্ষেত্রে। এই নিশ্চয়তাটুকু যদি না আসে। অনেক সংস্কার কমিশন অনেক ভালো ভালো কথা বলে গেছে। অনেক আইন হয়ে গেছে। নতুন কিছু নাই। ব্যাপারটা হচ্ছে প্রয়োগ নাই। যারা ল করে তারাই আইন ভাঙ্গে। শর্ষের মধ্যে যখন ভূত তখন ডাক্তার হিসেবে জনগণকে আগাই আসতে হবে। যাতে শর্ষের ভূত আমরা তাড়াইতে পারি। যেখানে কঠোর হওয়ার দরকার সেখানে আমরা কঠোর হব। যেখানে নরম হওয়া দরকার সেখানে নরম হব। যা আমরা বলছি, তা যেন ব্যক্তি পর্যায়ে ধারণ করতে পারি। যে যার পেশার প্রতি সৎ থাকলে দেখবেন দেশটা সুন্দর হয়ে গেছে। নাগরিক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব যেন ঠিকমত পালন করি। আইন মানার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলে বারবার বিপ্লবের দরকার হবে না। বারবার রক্ত দিতে হবে না।

সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য ড. মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা ও মিহরাজ আহমেদ, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরা।

আর কে

×