ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপক পদে দীর্ঘদিন ধরে ১০০ জনের পদ খালি
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপক পদে দীর্ঘদিন ধরে ১০০ জনের পদ খালি পড়ে আছে। সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদ মর্যাদার এসব পদ খালি থাকায় কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। অথচ যোগ্যতাসম্পন্ন অনেকে একই পদে আছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে।
আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালের কারণে তাদের পদোন্নতি হচ্ছে না। আবার অনেকে পদ দখল করে রাখলেও কর্মস্থলে থাকছেন না নিয়মিত। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে মূলত পাঠদান ও গবেষণার সঙ্গে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ মর্যাদার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ময়মনসিংহ মেডিক্যাাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে হাতেকলমে শিক্ষাদান করে থাকেন। রেকর্ডসংখ্যক অধ্যাপকের পদ খালি থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, এমবিবিএস ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের শিক্ষার্থীরা।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে বিদেশীসহ এমবিবিএস কোর্সে ১৫০২ জন, এমএম,এমডি, এমফিল ও এমপিএইচসহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ১৮১০ জন, ডেন্টাল কোর্সে ৩০৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাজমুল হাসান জানান, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ মিলবে খালি পদে অধ্যাপকদের পদায়ন জানাতে পারেননি তিনি।
কলেজ কর্তৃপক্ষীয় সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ৪৫ অধ্যাপকের মঞ্জুরি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১৩ জন। অধ্যাপক পদে ২৯ জনের পদ খালি পড়ে আছে। এর মধ্যে মেডিসিন বিভাগে ছয়জন অধ্যাপকের মধ্যে আছেন মাত্র দুজন। চারজন অধ্যাপকের পদ খালি দীর্ঘদিন ধরে। সার্জারি বিভাগে ৩ জন অধ্যাপকের মধ্যে আছেন মাত্র একজন! দ্জুন অধ্যাপকের পদ খালি। গাইনি এন্ড অবস বিভাগে ৩ জন অধ্যাপকের জায়গায় আছেন মাত্র দুজন। শিশু বিভাগে দুজন অধ্যাপকের স্থলে আছেন মাত্র একজন অধ্যাপক।
এর বাইরে অধ্যাপকের পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে নিউরোলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি, ফিজিক্যাল মেডিসিন, গ্যাস্ট্রোএন্টালোজি, হেপাটোলজি, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি, নিউরো সার্জারি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি, চক্ষু, ডার্মাটোলজি, সাইকিয়াট্রি, রেসপিরেটরি মেডিসিন, রিমাটোলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি, প্যাথলজি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমেস্ট্রির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও নেই কোনো অধ্যাপক। সহযোগী অধ্যাপকের ৭৩ মঞ্জুরি পদের বিপরীতে আছেন ৫৭ জন। এর মধ্যে ছয়জন আছেন সংযুক্তিতে।
তারপরও সহযোগী অধ্যাপকের ২০ জনের পদ খালি। সবচেয়ে বেশি পদ খালি পড়ে আছে সহকারী অধ্যাপক পদে। সহকারী অধ্যাপকের মঞ্জুরির ১১৩ পদের মধ্যে পদ খালি পড়ে আছে ৫০ জনের। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে সংযুক্তিতে আছেন রেকর্ডসংখ্যক ৪৪ জন সহকারী অধ্যাপক। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও চক্ষু বিভাগে সংকট সবচেয়ে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ কার্ডিলজি বিভাগে অধ্যাপকের মঞ্জুরি করা কোনো পদ না থাকায় সহযোগী অধ্যাপক দিয়ে চলছে বিভাগটি।
পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি ও হেমাটোলজি বিভাগে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক না থাকায় চলছে একজন মাত্র সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। ডেন্টিস্ট্রি বিভাগে কোনো অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকই নেই! বিভাগ চালান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংযুক্তিতে থাকা দুই সহকারী অধ্যাপক। সহযোগী অধ্যাপকের কোনো পদই নেই!
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৮তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া ডা. ইমরুল হাসান রবী মেডিসিন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে আটকে আছে গত আট বছর ধরে। অথচ ২০তম ও ২৪তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া অনেকে পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। ওপরের পদ খালি আছে, যোগ্যতাও আছে তারপরও ডা. রবীর পদোন্নতি নেই। ২০তম বিসিএস এ নিয়োগ পাওয়া ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ রতন পেডিয়াট্রিক সার্জারিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছেন গত আট বছর ধরে।
পদোন্নতির স্বাভাবিক নিয়মে ৩ বছর পর সহযোগী অধ্যাপক ও ৫ বছর পর তার অধ্যাপক হওয়ার কথা। পেডিয়াট্রিক বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকের পদও খালি আছে। অথচ আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালের কারণে শূন্যপদ পূরণ কিংবা পদোন্নতি কোনোটাই দেওয়া হচ্ছে না। ১৭তম বিসিএসএ নিয়োগ পাওয়া ডা. নাদিউজ্জামান খান একই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হন গত ২০১৩ সালে। পদোন্নতির হিসেবে ২০১৬ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক ও ২০২১ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা তার।
অথচ সহকারী অধ্যাপক থেকে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন ১১ বছর পর গত ২০২৪ সালে! ২০ তম বিসিএসএ নিয়োগ পাওয়া ডা. বদর উদ্দিন আহমেদ গত ২০১৬ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ইউরোলজি বিভাগে। গত আট বছর ধরে তিনি আটকে আছেন একই পদে! ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে শূন্যপদ থাকলেও পদোন্নতি বঞ্চনার এমন চিত্র কলেজের প্রতিটি বিভাগে। যোগ্যতা, ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা থাকার পরও শূন্যপদে পদোন্নতি না পাওয়ায় চরম হতাশায় ভুগছেন অনেকে।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবার ওপর। পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসির মাধ্যমে ২০ শতাংশ ও ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি-ডিপিসির মাধ্যমে বাকি ৮০ শতাংশ পদোন্নতি বিধান থাকলেও আমলাতান্ত্রি বেড়াজালে আটকে আছে এই পদোন্নতি। পদোন্নতি বঞ্চিত চিকিৎসকদের অভিযোগের আগে ক্ষমতায় থাকা স্বাচিপ, ড্যাব ও বিএমএ নেতৃবৃন্দকে নিজেদের পদ-পদবি ও জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নের লোভে চিকিৎসকদের অধিকার আদায়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ড্যাবের সাবেক কেন্দ্রীয় মহাসচিব অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে এমনটি হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদোন্নতি বঞ্চিত চিকিৎসকদের বিষয়টি দেখবেন কিনা প্রশ্নে জানান, এখন আর এসব দেখার সুযোগ নেই আমার। সূত্র আরও জানায়, গবেষণা ছাড়াও অধ্যাপক পদ মর্যাদার বিশেষজ্ঞ এসব চিকিৎসকগণ কলেজে নিয়মিত একাডেমিক ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণসহ এক হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের সেবার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে থাকেন।
দীর্ঘদিন যাবত রেকর্ডসংখ্যক অধ্যাপকের খালি পদে কোনো পদায়ন না থাকায় একাডেমিক কার্যক্রমসহ সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। এক হাজার শয্যার হাসপাতালে ৩ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকায় তাদের সামাল দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। অধ্যাপক সংকটে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। অধ্যাপকদের গবেষণা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।