ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১

শরীয়তপুরে দখল-দূষণে জড়িত প্রভাবশালীরা

অস্তিত্ব সংকটে নদী ও খাল

আবুল বাশার, শরীয়তপুর

প্রকাশিত: ২০:০০, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

অস্তিত্ব সংকটে নদী ও খাল

এভাবেই দখল করে নিচ্ছেন খাল

দখল, দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে শরীয়তপুরের ১১  নদ-নদী ও অসংখ্য খাল। এক সময়ের খরস্রোতা নদ-নদী এখন মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে নদী থেকে নির্বিচারে ও অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন তীরকে অরক্ষিত ও ভাঙনের ঝুঁকিতে ফেলেছে। মাটি উত্তোলনকারীরা কেবল মাটি উত্তোলনের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি, অনেকে নদীর পাড় দখল করে বিশাল এলাকাজুড়ে ইটভাঁটি বসিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা করে আসছেন। ফলে জেলার ৬টি উপজেলার নদ-নদী ও অসংখ্য খাল এখন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। জেলার নদ-নদী বা খালের হিসাব নেই জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে। নদ-নদীর হিসাব দিলেও খালের হিসাব দিতে পারেনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।
জেলা নদী রক্ষা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুরে মোট ১১টি ছোট-বড় নদ-নদী রয়েছে। এগুলো হলো- পদ্মা, মেঘনা (লোয়ার), কীর্তিনাশা, আড়িয়াল খাঁ, জয়ন্তী, মুন্সীরহাট, নাওডোবা, মরা কীর্তিনাশা, বুড়িরহাট-ভেদরগঞ্জ, কীর্তিনাশা (কাজীরহাট) ও সুরেশ^র-ডামুড্যা নদী।
২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই কীর্তনাশা নদীর বিভিন্ন অংশে পাড় দখল হয়ে যাওয়ায় নদী সংকুচিত হয়ে গেছে। এক সময় এই নদীর প্রবল প্রবাহে ছুটে চলার আনন্দ আর ঘূর্ণিপথের বাঁকে বাঁকে যে রহস্যময়তা সৃষ্টি হতো, প্রবীণদের মুখের সেই বিবরণ এখন হাস্যকর মনে হয়। দুই যুগ আগেও লঞ্চ এবং পণ্য বোঝাই নৌকা এই নদীতে চলাচল করত, যা নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ^র বন্দর, সদর উপজেলার গয়াতলা বাজার, রাজগঞ্জ বাজার ও আংগারিয়া বন্দরের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হিসেবে খ্যাতি ছিল। এ ছাড়া স্থানীয়রা কৃষিকাজ, গৃহস্থালীর কাজ ও মাছ ধরার জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে নদীটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। দখল, দূষণ আর নদী থেকে বালু উত্তোলন এবং নদীর পাড় কেটে মাটি নেওয়ার কারণে এই নদীটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। শরীয়তপুর সদর উপজেলার কোটাপাড়া, রাজগঞ্জ ও আংগারিয়া, নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর, ভোজেশ^রসহ অন্যান্য এলাকায় কীর্তিনাশা নদীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে কয়েকটি ইটভাঁটি। গত প্রায় দেড় যুগ ধরে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর তীর দখল করে ইটভাঁটি তৈরি করার ফলে একদিকে নদী যেমন সংকুচিত হয়েছে, অন্যদিকে নদীর স্রোত কমে গিয়ে অনেকটা মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সদর উপজেলার রাজগঞ্জ বাসিন্দা আব্দুর রহিম, শাহিন, মোশরফসহ অনেকে বলেন, এই কীর্তিনাশা নদী দিয়ে এক সময় বড় বড় লঞ্চ ও কার্গো চলাচল করত। এখন নৌকা, ট্রলার চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
বুড়িরহাট-ভেদরগঞ্জ নদীটির উৎসমুখ নড়িয়া উপজেলার সুরেশ^রের পদ্মা নদী, যা ডামুড্যা উপজেলার জয়ন্তী নদীতে মিলিত হয়েছে। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর পাড় দখল করে ভেদরগঞ্জ উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে বড় ্বড় পাকাভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় এক যুগে দখল হয়ে গেছে নদীর অধিকাংশ পাড়। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেনি বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। ডামুড্যা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জয়ন্তী নদীর উৎসমুখ বুড়িরহাট-ভেদরগঞ্জ। ডামুড্যা উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে নদীর পশ্চিম পাড় দখল করে দোকানপাট, ফামের্সী ও বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণসহ পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া নদীর পূর্বপাড় বালু ব্যবসায়ীরা দখল করে সেখানে বালুর স্তুপ তৈরি গড়ে তুলেছেন। ফলে নদী সংকুচিত হয়ে গেছে। এখানে নদী থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ডামুড্যা বন্দরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কামাল আহম্মেদ, শামীম, শিক্ষক আব্দুর রব মিয়াসহ অনেকে জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। ফলে সরু হয়ে গেছে নদী। একই অবস্থা সুরেশ^র-ডামুড্যা নদীর। যার উৎসমুখ পদ্মা ও পতিতমুখ জয়ন্তী নদী। ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীটির ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর, কার্ত্তিকপুর, নারায়ণপুর, ডামুড্যা উপজেলার বিভিন্ন অংশে নদীর পাড় দখল গড়ে ইটভাঁটি, ঘরবাড়িসহ পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ তারেক হাসান মুঠোফোনে বলেন, আমাদের নিকট নদী ও খালের কোন পরিসংখ্যান নেই। এগুলো কোথায়, কে ভরাট করেছে বা দখল করেছে তা জেলা প্রশাসক অফিস থেকে জানতে পারবেন।শরীয়তপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য মো. রাসেল নোমান বলেন, এ বিষয়ে ভালো তথ্য দিতে পারবে নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক। এসব বিষয় সম্পর্কে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মাসুদুল আলমের মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা একটি মিটিং করেছি।
শরীয়তপুর জেলায় ১১টি নদী চিহ্নিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ইউএনও, এসিল্যান্ড এবং জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। কোথায়ও কোন অবৈধ স্থাপনা আছে কিনা তার তালিকা দেওয়ার জন্য তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং আমরা এগুলো উদ্ধার করার জন্য নদী রক্ষা কমিশনের কাছে বাজেট চেয়েছি। এ বিষয়ে জানতে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও শরীয়তপুর জেলা প্রশাসককে মুঠোফোনে বার বার ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। 

×