ফটিকছড়ি উপজেলা জুড়ে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো অবাধে গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন ওষুধের ফার্মেসি দোকান। এসব ফার্মেসিগুলোতে মেয়াদ উত্তীর্ণ, নকল এবং অবৈধভাবে আসা বিভিন্ন দেশের ওষুধে সয়লাব। অনুমোদিত ওষুধের দোকান পুরো উপজেলায় চার শতাধিক হলেও অবৈধ অননুমোদিত দোকানের সংখ্যা কয়েক হাজার। এসব ওষুধ বিক্রেতাদের নেই কোনো দক্ষতা প্রশিক্ষণ আর বৈধ ড্রাগ লাইসেন্স। অনুমোদিত দোকানেও বিক্রি হচ্ছে চায়না, ভারত ও হংকং সহ বিভিন্ন দেশের নিষিদ্ধ, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও ভেজাল কোম্পানির ওষুধ।
এ কারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা। বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট ফার্মেসির মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরিয়ে ফেলে ধ্বংস করার জন্য নির্দেশ দিলেও কেউ তাতে কর্ণপাত করছে না। এসব ভেজাল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও নিষিদ্ধ ওষুধের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসনের তৎপরতাও চোখে পড়ছে না। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা মেতেছেন ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার মোট ১৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় বৈধভাবে ওষুধ প্রশাসনের লাইসেন্স এবং নিবন্ধিত ফার্মেসি রয়েছে মাত্র ৩০০ টি। অপরদিকে, অনুমতি ও প্রশিক্ষণ ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে হাজারের অধিক ফার্মেসির দোকান। এসব দোকানে জীবন রক্ষার নামে বিক্রি হচ্ছে নকল, অনুমোদনহীন কোম্পানির ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন দেশের নিষিদ্ধ নানা ধরনের ওষুধ ও ফিজিশিয়ান স্যাম্বল। অপরদিকে, ফার্মেসিতে যে তাপমাত্রায় ওষুধ রাখার কথা, সেই তাপমাত্রায় রাখা হচ্ছে না।
ফলে ওষুধের গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব নকল, ভেজাল ও নিষিদ্ধ ওষুধের রমরমা বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। এই ওষুধ সেবনে বিপুল সংখ্যক রোগী নিরাময়ের বদলে স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতার শিকার হচ্ছেন।মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ওষুধ বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এসব ওষুধ অসুস্থ রোগীকে সুস্থতার বদলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের তেমন কোনো জোরালো উদ্যোগ নেই ফটিকছড়ি উপজেলায়। এতে রমরমা হয়ে উঠেছে অবৈধ এসব ওষুধের ফার্মেসিগুলো। অনুমোদনহীন ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের এসব ওষুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। এতেই কিছু ওষুধ অসাধু চিকিৎসক ঔষধ কোম্পানিগুলো ফাঁদে পা দিয়ে কিছুটা লাভের আশায় রোগীদের ঠেলে দিচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। গাইনি ও চর্মরোগীদের দেয়া হচ্ছে বিদেশি নিষিদ্ধ অধিক মূল্যের ওষুধ। জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে সৃষ্টিকর্তার পরই ডাক্তারদের অবস্থান রাখেন রোগীরা।
কিন্তু সে ডাক্তারই যখন নিজেদের নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অল্প লাভের আশায় রোগীদের অসহায়ত্তের সূযোগে মরণ কামড় দেন,রোগীদের তখন মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কোম্পানিগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেয়া এসব ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অহরহ। এলোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক ও হারবাল সব ওষুধেও মিলছে ভেজাল। দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার এসব অবৈধ ফার্মেসিতে এ ধরনের ওষুধ বিক্রয় করে আসছে বলে একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে, বিবিরহাট বাজারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফার্মেসির দোকানদার বলেন, আমাদের কি দোষ। ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ আগে ডাক্তারদের ম্যানেজ করে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে অনুমোদনহীন ভেজাল ওষুধের নাম লিখে দেন। তাই, অনেকটা বাধ্য হয়েই আমরা দোকানে এসব ওষুধ বিক্রি করছি। এসব ভেজাল ও নিষিদ্ধ ওষুধ সংরক্ষণ ও বিপণন আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে, যদি ডাক্তাররা এসব ওষুধ রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লেখা বন্ধ করে দেন।
এ ব্যাপারে, বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির ফটিকছড়ি শাখার সাধারণ সম্পাদক মো: পারভেজ চৌধুরী বলেন, আমাদের হিসেবে পুরো উপজেলাজুড়ে ওষুধ প্রশাসনের লাইসেন্স এবং নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট রয়েছে প্রায় ৩০০টি ফার্মেসির। ফটিকছড়ি প্রত্যন্ত ও ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় অনুমোদনহীন ও অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ১ হাজারের বেশি ফার্মেসি। আমরা আমাদের সমিতির মাধ্যমে এসব অবৈধ ফার্মেসির মালিকদের বহুবার বলেছি অনুমতি নিয়ে ফার্মেসির ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত না করে অবাধে নকল, অনুমোদনহীন কোম্পানির ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অবৈধ বিদেশি ওষুধ বিক্রি করে আসছে। বারবার বলার পরও কিছু অসাধু অনুমোদিত ফার্মেসি মালিকও ভেজাল ও বিদেশি নিষিদ্ধ মজুত ও বিক্রি করছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
এব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক এস.এম. সুলতান আরেফিন বলেন, ইতিমধ্যে আমরা প্রশাসনিকভাবে যে সব ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে সেসব ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ১৫ই ডিসেম্বর শনিবার নাজিরহাট ও বিবিরহাট বাজারে চারটি ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ও বিদেশী নিষিদ্ধ ওষুধ জব্দ করেছে। ভেজাল ও বিদেশী নিষিদ্ধ ওষুধ সংরক্ষণ ও বিক্রির দায়ে তাদের সর্বমোট ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। অনুমোদিত ফার্মেসি ও ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ফটিকছড়ি উপজেলার এসিল্যান্ড ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, উপজেলার ফার্মেসিগুলোতে ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিদেশী নিষিদ্ধ ওষুধ সংরক্ষণ ও বিক্রি রোধ করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। ঔষধ প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা প্রস্তুত আছি। অভিযান অব্যাহত রাখলে এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমানো সম্ভব।
এসআর