ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ত্বরিত পদক্ষেপে ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ

কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকে জিম্মিদের উদ্ধার

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:১৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২২:৩৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকে জিম্মিদের উদ্ধার

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় রূপালী ব্যাংকে ডাকাতির খবরে ব্যাংকের সামনে উৎসুক জনতার ভিড়

তিন ডাকাতের আত্মসমর্পণ
রাজধানী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের রূপালী ব্যাংক শাখায় ডাকাতদের সাড়ে ৩ ঘণ্টা জিম্মিদশা থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিন ডাকাতকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডাকাত দলের কাছ থেকে তিনটি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ব্যাংকের ভল্ট ভাঙতে পারেনি ডাকাতরা। জিম্মিরা সবাই অক্ষত রয়েছেন। ব্যাংকের ভেতরে ডাকাত দল প্রবেশ করে কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের জিম্মি করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ ও সেফ একজিট (নিরাপদ প্রস্থান) দাবি করে। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার ডাকাত দলের জিম্মি অবস্থার অবসান ঘটাতে তাদের আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করা হয়। 


বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার ডাকাত দলের আত্মসমর্পণের পর ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের উদ্ধার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন ডাকাত ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পাশের একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টার কথা বলা হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ডাকাত দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের আত্মসমর্পণে রাজি করানো হয়। ডাকাত দলের সদস্যরা জানালা দিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করে। একটি বন্দুক জানালা দিয়ে ফেলা হয়। বাকি অস্ত্র ব্যাগে ভরে বাইরে ফেলে দেয় ডাকাত দলের সদস্যরা। পরে একে একে ডাকাত দলের সদস্যরা বেরিয়ে আসে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িতে করে ডাকাত দলের সদস্যদের নিয়ে যাওয়া হয়।


স্থানীয়রা ও ব্যাংকের ভেতরে অবস্থানকারী ব্যাবসায়ীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে ডাকাতরা ওই ব্যাংকের দ্বিতীয় তলায় ঢুকে পড়ে। তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে ব্যাংকে ঢোকে, তখন নিচে অন্যান্য লোকজন ও ব্যবসায়ীরা বিষয়টি টের পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ব্যবসায়ী ও লোকজন ব্যাংকের প্রবেশ ও বের হওয়ার একমাত্র সিঁড়ির মুখে থাকা কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেন। এরপরই ব্যাংকের ভেতরে থাকা ডাকাতরা সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

খবর পেয়ে তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসে ব্যাংকটি ঘিরে ফেলেন। পরে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনীও ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়। তখন ব্যাংকের ভেতরে কর্মকর্তাসহ ১০-১২ জন স্টাফ জিম্মি হয়ে পড়েন। অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা তখন ডাকাতদের সঙ্গে ‘সমঝোতা’র জন্য চেষ্টা চালান। এমন পরিস্থিতিতে জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের ‘সেফ এক্সিট’ বা নিরাপদে প্রস্থান ও ১৫ লাখ টাকা দাবি করে ডাকাতরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ডাকাত দলের সদস্যরা চিরকুটের মাধ্যমে নিজেদের মোবাইল নম্বর দিয়েছিল। সেই মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে ডাকাত দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তিন ডাকাত সদস্যেরই বয়স ১৮-২২ বছরের মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ডাকাত সদস্যদের বিস্তারিত পরিচয় জানানো হয়নি। এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ডাকাতদের ব্যাংক থেকে আটক করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে দুপুর ২টার দিকে ডাকাতরা ওই ব্যাংকে হানা দেয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যাংকটির আশপাশের এলাকা ঘিরে রাখে।


র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক (সিও) খলিলুর রহমান হাওলাদার ঘটনাস্থলের উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে ডাকাত দলের সদস্যরা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ব্যাংকের ভেতরে থাকা জিম্মিদের মধ্যে কেউ হতাহত হননি। অর্থ লোপাটের ঘটনাও ঘটেনি। তারা ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা জিম্মি করে রাখে। পরে যৌথ বাহিনীর তৎপরতায় ৩ ডাকাতকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। 


র‌্যাবের পক্ষ থেকে এক বার্তায় জানানো হয়েছে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় রূপালী ব্যাংকে ঢুকে ১৫ লাখ টাকা দাবি করা ৩ ডাকাত ৩টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ডাকাত দলের জিম্মি করা ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চুনকুটিয়া  এলাকায় রূপালী ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত টিম।

এ সময় অস্ত্রধারী তিন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে জিম্মি ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের অক্ষত উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ অভিযান চালানো হয়। এর আগে বেলা দেড়টার দিকে ব্যাংকে ঢুকে অস্ত্রের মুখে কর্মকর্তাদের জিম্মি করে রাখে তারা। খবর পেয়ে পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর টিম ব্যাংকটি ঘেরাও করে রাখে।


র‌্যাব কর্মকর্তা তাপস কর্মকার বলেছেন, বিকেল সাড়ে ৫টায় তিন ডাকাত আত্মসমর্পণ করেছে। ব্যাংকের ভেতরে ১৬ জন জিম্মি ছিলেন, যাদের মধ্যে চারজন ব্যাংক কর্মকর্তা, আর বাকি ১২ জন গ্রাহক। প্রত্যেকেই অক্ষত রয়েছেন। একদল ডাকাত ব্যাংকে ঢুকে কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ডাকাতির চেষ্টা করে খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাব যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে অস্ত্রসহ তিনজন আত্মসমর্পণ করেছে। ডাকাত দলের তিনজন ভেতরে প্রবেশ করে।

আর বাকিরা বাইরে অবস্থান করছিল। বিনা রক্তপাতে তিন ডাকাতকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ডাকাতদের আত্মসমর্পণের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে আমরা তাদের সঙ্গে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তাব দিই। নেগোসিয়েশনের একপর্যায়ে তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য রাজি হয়। তবে বিক্ষুব্ধ জনতার কাছ থেকে নিরাপদে তাদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। সেই অনুযায়ী, তাদের হেফাজতে নিয়ে কেরানীগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।


পুলিশের কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডাকাত পড়ার খবর পেয়ে প্রথমে স্থানীয়রা জড়ো হয়ে ব্যাংকের গেটে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে ব্যাংকের ওই শাখার চারপাশে অবস্থান নেয়। তারা আলোচনার মাধ্যমে ডাকাতদের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা চালান। ব্যাংকে ডাকাত দলের হানা দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে উৎসুক জনতা ভিড় করে। ব্যাংকের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পুলিশ, র‌্যাব ও সেনা সদস্যরা তাদের বারবার দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পাশের একটি মসজিদের মাইক থেকে ডাকাত দলকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়। প্রয়োজনে যাতে ব্যাংকের ভেতরে অভিযান চালানো যায়, সেই প্রস্তুতিও নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।


ব্যাংকের ম্যানেজার শেখর মন্ডল জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি ব্যাংকের বাইরে ছিলেন। তাদের সঙ্গে আমরা নেগোশিয়েট করছি। ব্যাংকের জিএম ইসমাইল হোসেন শেখ বলেন, ব্যাংকের ভেতরে ৩ জন ডাকাত অস্ত্রসহ ঢুকেছে। তারা আটকা পড়ার পর সেফ একজিট (নিরাপদ প্রস্থান) ও ১৫ লাখ টাকা দাবি করছে। রাজধানীর কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের ভেতরে গ্রাহক-কর্মকর্তাসহ ১২ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছে ডাকাত দল। 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ব্যাংকে ডাকাত দলের হানা দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উৎসুক জনতা সেখানে ভিড় করেছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাংক সংলগ্ন মূল সড়কের উভয় পাশের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডাকাত দলকে আত্মসমর্পণ করার জন্য পাশের মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। 
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেলা দুইটার দিকে ব্যাংকের ভেতরে ডাকাত দল হানা দেওয়ার খবর পেয়ে এলাকাবাসী জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে ব্যাংকে ডাকাত দলের প্রবেশের বিষয়টি মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়। এ সময় এলাকাবাসী ব্যাংকটির চারপাশ ঘেরাও করে প্রবেশের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। খবর পেয়ে প্রথমে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে যায়।

বিকেল চারটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রইছ আল রেজওয়ানসহ র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।


দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের জিঞ্জিরা শাখায় ডাকাতির চেষ্টা চালানো তিনজন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জিম্মি রাখার পর বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তারা অস্ত্রসহ তিনজন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে তাদের কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি সোহরাব আল হোসাইন বলেন, তিন ডাকাত আমাদের হেফাজতে রয়েছে। তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টার সময়ে তিন ডাকাত ভেতরে প্রবেশ করলেও বাকিরা বাইরে ছিল। যৌথ বাহিনীর উপস্থিতি ও অভিযানের প্রস্তুতি দেখে ব্যাংকের বাইরে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা পালিয়ে গেছে। ব্যাংকের বাইরে থাকা যেসব ডাকাত দলের সদস্য পালিয়ে গেছে তাদের নাম সংগ্রহ করে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হবে।

×