ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও রস

নিজস্ব সংবাদদাতা বাকেরগঞ্জ, বরিশাল

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও রস

খেজুর গাছ ও রস

আধুনিকতা ও কালের বিবর্তনে জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরের গাছ, রস ও গুড়। ১৪ টি ইউনিয়ন নিয়ে বৃহত্তম এ উপজেলায় এক সময় পরিপূর্ণ ছিলো খেজুর গাছে।

গ্রামীণ মেঠো পথের দুই পাশেই চোখ বুলালেই দেখা যেত সারি সারি খেজুর গাছ। এখন আর এমন দৃশ্য সহজেই দেখা মেলেনা, প্রায় তা বিলুপ্তির পথে। গ্রামগঞ্জে এই খেজুরের গুড় ও রস ছিল সর্বজন সমাদৃত। তৎকালীন সময়ে গ্রামে গ্রামে শীতের আগমনে গাছিরা ব্যাস্ত হয়ে পড়তো।

এখন তেমন একটা দেখা যায় না। দিন দিন খেজুরের গাছ কমতে থাকায় গাছিরাও বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। সেকালে গাছিরা যখন খেজুর গাছের রস সংগ্রহের জন্য গাছ তুলতো তখন শিশু-কিশোরেরা গাছির পিছনে ঘুরঘুর ঘুরতো খেজুর গাছের চুমরী খাওয়ার জন্য ও গাছের লাল শরফার জন্য। এই শরফা পুড়িয়ে কচু পাতায় বেধে সন্ধ্যায় বাজি ফুটিয়ে আনন্দ উল্লাস করতো যা এখন শুধুই স্মৃতি। 

খেজুর গাছে গাছে ঝুলানো হতো মাটির তৈরি রসের হাড়ি। কনকনে শীতে গাছিরা চাদর জড়িয়ে হেরিকেন জ্বালিয়ে চোরের ভয়ে গভীর রাত পর্যন্ত গাছে পেতে রাখা রসের হাড়ি পাহারা দিত। শীতের বিকেলে গাছিরা মাটির তৈরি রসের হাড়ি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করত।

গাছিরা খেজুর গাছ তুলার এক মাস আগেই কুমারপাড়া ও সাপ্তাহিক হাটগুলো থেকে পছন্দমত মাটির তৈরি রসের হাড়ি ক্রায় করতো। এখন খেজুর গাছ কমতে থাকায় কুমার পাড়ার হাড়ি তৈরি তেমন দেখা যাচ্ছে না। গাছিরা এখন মাটির তৈরি হাড়ির পরিবর্তে প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যাবহার করছে।

তখন গ্রামের প্রায় বাড়িতে নতুন ধানের চাউল দিয়ে খেজুরের রসের পায়েশ রান্না দুধ চিতই পিঠা বানানোর ধুম পড়তো। আর গ্রামের মানুষ স্বজনদের নিয়ে অতিআনন্দে পায়েশ ও দুধ চিতই পরিবেশন করতো। এখন তা ফুরিয়ে যাচ্ছে।

ভরপাশা ইউনিয়নের গাছি কুদ্দুস মুন্সীর সাথে কথা হলে জানান, আমরা খেজুরের রস ও গুড় তৈরীর কাজ ছেড়ে দেওয়ার পথে। কারণ আগে বাড়ির আঙিনাসহ ভিটে বাগান বাড়িতেও খেজুরের গাছ ছিল।

এখন ঘনবসতি হওয়ার কারনে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করায় গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। শত শত খেজুর গাছ ছিলো তখন অতি সহজে গাছ কেটে রস ও গুড় তৈরী করতে সহজ হতো কিন্তু এখন তা হয় না।

এক গাছ থেকে আরেক গাছের দুরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। এখন ৫/৭ টি খেজুর গাছে রসের হাড়ি দিতে দিন চলে যায়। এতে শ্রম ও সময় ঠিকই চলে যায় খেজুরের রস তেমন পাওয়া যায়না। এ জন্য এখন এই কাজ করে নিজেদের সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

কলসকাঠী ইউনিয়নের গাছি বারেক হাওলাদার জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শতাধিক অবৈধ ইটভাটার কারনে এই খেজুর গাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়াও আমাদের কলসকাঠী ইউনিয়নে প্রায় অর্ধশত ইট ভাটায় প্রতি বছর শত শত গাছ কেটে ইট পোড়ানো হচ্ছে। যার কারণে খেজুর গাছেরও শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এমন চলতে থাকলে দুই এক বছরের মধ্যেই আমাদের এলাকায় খেজুর গাছ বিলীন হয়ে যাবে।

সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে খেজুর গাছ দেশ থেকে বিলীন হবে না। গ্রামীন এই ঐতিহ্য প্রকৃতিক সম্পদ বিলীনের হাত থেকে বাঁচতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসতে হবে।

জানা যায়, শীত মৌসুমে শীত যতো বাড়তে থাকে খেঁজুর রসের মিষ্টতাও ততো বাড়ে। শীতের সাথে রয়েছে খেঁজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। এক সময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হতো পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালী তৈরীর ধুম।

গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও বাটালী গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যেতো। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজা পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারেরতো জুড়িই ছিলোনা।

কিন্তু কালের পরিবর্তনে প্রকৃতি থেকে আজ খেজুরের রস একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীণ বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ আর গুড়ের জন্য একসময় দক্ষিণ অঞ্চল বিখ্যাত ছিলো।

অনেকে শখের বশে খেজুর গাছকে মধুবৃক্ষ বলে থাকতেন। শীতের মৌসুমে খেজুর রসের নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো গ্রামীন জনপদ। শখের বসত প্রাকৃতিক ভাবে জন্মানো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিদের মতে, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল আসলেই অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামীণ জনপদের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যায়। বর্তমানে এসব অঞ্চলে প্রতি হাড়ি খেজুর রস এক থেকে দুই শত টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম।

এই অঞ্চলের গাছিরা বলেন, খেজুর গাছ রক্ষায় বন বিভাগের কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না থাকায় ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ আর শীতের মৌসুমে খেজুর গাছের রস শুধু গল্পে পরিনত হতে চলেছে।

স্থানীয়রা জানান, ঐতিহ্যবাহী এ খেঁজুর রসের উৎপাদন বাড়াতে হলে টিকিয়ে রাখতে হবে খেজুর গাছের অস্তিত্ব। আর সে জন্য যথাযথ ভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটাসহ যেকোন বৃক্ষ নিধনকারীদের হাত থেকে খেঁজুর গাছ রক্ষা করতে হবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুনীতি কুমার সাহা বলেন, সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু এলাকায় কৃষকদের খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পার্শের পরিত্যক্তস্থানে কৃষকেরা পর্যাপ্ত পরিমান খেজুর গাছ রোপন করলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।

আর কে

×