আজ ১৮ ডিসেম্বর। নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরটি হানাদার মুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতার বিজয় অর্জন করেছিল। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর অবাঙালী অধুষ্যিত সৈয়দপুর ছিল অমীমাংসিত । সৈয়দপুরকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছিল মিত্রবাহিনী ও বীরমুক্তিযোদ্ধারা। পরে পাকি সেনারা এক ধোপার মাধ্যমে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণের প্রস্তাব পাঠিয়ে আলোচনার বসে আসমর্পণ করেছিল ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। ফলে ১৮ ডিসেম্বর সৈয়দপুর এলাকাটি হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
সৈয়দপুর বাংলাদেশের অষ্টম ব্যবসা বানিজ্যের শহর। সারা দেশের মানুষজন সৈয়দপুরকে এক নামে চেনেন। অবাঙালী শহর হিসাবেও আজও পরিচিত সৈয়দপুর। প্রতিদিন ঢাকার সাথে ১৬টি বিমান চলাচল করে। এ ছাড়া কক্সবাজার রুটেও সপ্তাহে দুইদিন বিমান চলাচল করছে। এ ছাড়া সড়ক ও রেলপথে বিলাশবহুল বাস ও আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এই সৈয়দপুর নিয়ে রয়েছে অনেক ইতিহাস। যার বড় ইতিহাস স্বাধীনতা যুদ্ধ। একটু ভিন্নটার কারনে সৈয়দপুরে ২৬ মার্চের তিনদিন আগে যেমন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তেমনি ১৬ ডিসেম্বরের ২ দিন পর হানাদার মুক্ত করতে সময় লেগেছিল। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ অঞ্চলে পাকিসেনারা এই সৈয়দপুরকে তাদের প্রধান ঘাটি হিসাবে ব্যবহার করেছিল এবং শতশত স্বাধীনকামী বাঙালী নারী পুরুষ হত্যা শিকার হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান,১৯৭১ এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রত্য লড়াই শুরু হলেও সৈয়দপুরে শুরু হয়েছিল এর ৩ দিন আগে। পাঞ্জাব পাকসেনারা সৈয়দপুরের নাম বদলে দিয়ে নামকরণ করেছিল গাজীপুর। পাকিস্তানীদের ইচ্ছে অনুসারে সে সময় নীলফামারীর সৈয়দপুরে এয়ারপোর্টটির নামকরণ করা হয় জমজম এয়ারপোর্ট।
সে সময় সৈয়দপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকার পাকবাহিনীর ১৬ ডিবিশনের জিওসি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফী ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট সম্পন্ন করে নীলফামারী-রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল।
এই শহরের প্রথম শহীদ হন শহরের পাশ্ববর্তী চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকডিহি ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহতাব বেগ। তিনি শহরের আটকেপড়া বাঙালীদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয় ২৩ মার্চ ভোরে। ২৪ মার্চ তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) ডা. জিকরুল হক, ডা. শামসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ডা.আমিনুল হক. ডা. ইয়াকুব আলী ও তুলশীরাম আগরওয়ালাসহ অনেককে গ্রেফতার করে রাখা হয় স্থানীয় সেনানিবাসে। সেখানে ৩ সপ্তাহ ধরে নির্যাতন চালানো হয় তাদের উপর। অতপর ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন দক্ষিনপশ্চিম পাশে অবস্থিত নিসবতগঞ্জ বালারখাল নামক স্থানে তাদেরকে হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কমলা প্রসাদ জীবিতকালীন সময়ে জানিয়েছিলেন, ওই বধ্যভ‚মিতে সেদিন একসাথে হত্যা করা হয় প্রায় ৩০০ জনকে। এরা ছিলেন সবাই সৈয়দপুরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের বয়লার শপে জীবন্ত নিপে করে প্রায় ৩০০ বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৩ জুন কৌশলে মাড়োয়ারী পরিবারদের রেলস্টেশনে একত্রিত করে ভারতের হলদিবাড়ি পৌছে দেয়ার নামে গোলাহাট নামক স্থানে এনে হত্যা করা হয়।
মুক্তিবাহিনী দলের তৎকালীন যুদ্ধকালীন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সামসুল হক সরকার জানান, পাকবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়। তবে যুদ্ধের সব প্রস্তুতি থাকলেও পাকবাহিনী যুদ্ধ ছাড়াই আত্নসমর্পণ করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈয়দপুর স্মরণিকা পরিষদের সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাজাহান সরকার জানান, সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত হওয়ার খবরে বিজয়ের আনন্দে মুক্তি পাগল হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে
আসে। ১৮ ডিসেম্বর- মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত কাজী ওমর আলী জনতার মিছিল নিয়ে সৈয়দপুর পৌরসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। এরপর সৈয়দপুরকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
পাকি সেনারা আত্মসমর্পণ করলো যে ভাবেঃ- ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর নীলফামারীর খড়খড়িয়া নদীর তীরে পাকবাহিনীর ঘটে চূড়ান্ত পরাজয়। ১৩ ডিসেম্বর নীলফামারী মহকুমা শহর সহ ডোমার,ডিমলা,জলঢাকা ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হতে থাকে। জীবন বাঁচার শেষ চেষ্টায় পাকি সেনারা আশ্রয় নিতে থাকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। কার্যত, তখন তারা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে আটকা পড়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর ২৩ ব্রিগেডের পাকি কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফী বুঝতে
পারেন, মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অন্তত প্রাণে বাঁচতে হলে আত্মসমর্পণের বিকল্প নেই। একজন ধোপাকে মিত্রবাহিনীর কাছে প্রেরণ করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। মিত্রবাহিনীর উত্তর পশ্চিমাংশের জেওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এমএল তপন সে সময় ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রধান জিওসি মেজর জেনারেল পিসি রেড্ডিকে একটি হেলিকপ্টারে করে নীলফামারীর দারোয়ানী প্রেরন করেছিলেন। সেখানে পাক মেজর ইকবাল শাফী এসে আত্নসমর্পণের বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাকবাহিনীকে একত্র করার জন্য ১৭ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত সময় নেয় পাকি সেনা। আত্নসমর্পণ করা হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের ভেতরে থাকা সৈয়দপুরের জমজম বিমানবন্দরে।পাকি কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফীর অধীনে ৩৪ পাঞ্জাব (নীলফামারী), ২৫ পাঞ্জাব (লালমনিরহাট), ৪৮ পাঞ্জাব (ঠাকুরগাঁও) এবং ২৬ ফ্রন্টিয়ারস ফোর্সসহ (দিনাজপুর) এর ১১১ জন পাক-অফিসার, ১৫৫ জন জেসিও, ৪ হাজার ৪৩২ জন সৈনিক, অন্যান্য ৭৯, বেসামরিক ৩৭, মোট ৪ হাজার ৮১৪ জন আত্নসমর্পণ করেছিল।পাকি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফী ও মিত্রবাহিনীর জেনারেল নজর হোসেন স্বারিত আত্নসমর্পণের দলিলটি ভারতে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়।
তাহমিন হক ববী/জাফরান