শুঁটকি পল্লীতে কাজ করছেন মুন্নী
অন্তত আট বার ঘর পাল্টেছেন। তাও অন্যের আশ্রিত ঘর। এবাড়ির বারান্দা। ওবাড়ির সামনের খাস জমিতে কিংবা নদীর পাড়ে অবস্থান করেছেন। সবশেষ এক শুঁটকি ব্যবসায়ীর একটি খালি ঘরে থাকছেন। এখানে কতদিন থাকতে পারবেন তাও জানেন না। ওখানেই স্বামী, দুই সন্তান নিয়ে অনিশ্চিত বসবাস মুন্নী বেগমের। সবাই মুন্নী নামেই চেনেন। দুইটি যুগ এভাবে ¯্রােতে ভাসা শ্যাওলার মতো ভাসছেন মুন্নী। স্বামী, নামেই বাহাদুর। অটো-ভ্যান চালানোর কাজ করতেন। এখন তাও পারেন না।
শারীরিকভাবে অসহায়, অসুস্থ। এখন কাজকর্ম তেমন করতে পারেন না। বড় সন্তান নয় বছরের আঁখিমণি এ বছর ক্লাস টুর ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়েছে। আর ছোট্ট ছয় বছরের আবু বকর সিদ্দিককে মাদ্রাসায় পাঠানোর চিন্তা করছেন মুন্নী। তবে আর্থিক চরম অসহায়ত্ত সন্তানদের লেখাপড়ায় পাহাড়সম বাধা হয়ে আছে। দুলছে চরম অনিশ্চয়তায়। তারপরও মুন্নি ঠেলছেন জীবিকার চাকা। তবে গতি সচল রাখতে পারছেন না। তারপরও ভোর থেকে রাত অবধি মাছ বাছাই করেন নদী পাড়ের জেলে পল্লীতে। আবার লইট্টা শুঁটকির মাচানেও কাজ করেন। কখনো মধ্য রাত অবধি কাজ করেন। এ জন্য দৈনিক ২০০-৩০০ টাকা সর্বোচ্চ পেয়ে থাকেন।
এখন শুঁটকি পল্লী মহিপুর ইউনিয়নের খালগোড়ায় কাজ করেন এই অসহায় নারী। জানালেন, প্রতিদিন কাজ থাকে না। কখনো মাসের পর মাস বেকার থাকেন। ৩০ বছর বয়সী মুন্নীর ২৪টি বছর এভাবে মহিপুর মৎস্য বন্দর থেকে খালগোড়া পর্যন্ত জনপদে মাছ বাছাইসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। হার না মানা লড়াই চলছে মানুষটির। বললেন, ‘স্যার, কষ্টের জীবন যেন শ্যাষ অয় না।’ দুই সন্তানের চিন্তায় রাতের বাকি সময় ঘুমুতে পারেন না। স্বামীর অসুখের চিকিৎসা করাতে পারেন না।
দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় কাটছে মুন্নীর একেকটি প্রহর। সন্তানদের পেটের তিন বেলা অন্নের জোগান যেন নিত্যদিনের দুশ্চিন্তা মুন্নীর। নিজের কষ্টটুকু উপলব্ধির সময়টুকুও যেন নেই তার। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর মৎস্য বন্দর থেকে পশ্চিম দিকে আন্ধারমানিক নদী পাড়ের খালগোড়ায় বর্তমান অবস্থান মুন্নীর।
মুন্নী জানন, তখন বয়স তার আনুমানিক ছয় বছর। মা খুর্শিদা বেগমের হাত ধরে ছোট ভাই চার বছর বয়সী ইমাম আর নবজাতক আরেক ভাই হাসানকে নিয়ে মহিপুরে আসেন মুন্নী বেগম। দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। কক্সবাজারের নুইন্যাছড়ায় বাবা শফি আলমের জেলে পেশার ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের পরিবারটি। বাবার মৃত্যুর পরে সবাই আশ্রয় হারা হয়ে গেছেন। বদলে গেছে ঠিকানা। ভালোমন্দ বোঝার আগেই মায়ের সঙ্গে মহিপুরের মাছের বিভিন্ন আড়তে মাছ বাছাইকরণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে পেটের জোগান চলে মুন্নীদের। এ বাড়ির বারান্দায়। ও বাড়ির সামনে।
কারও আশ্রিতা-এভাবেই কাটে এক যুগ। এরই মধ্যে মুন্নী আবার স্কুলেও যেতেন। তবে পঞ্চমেই ক্ষ্যান্ত। জীবনের ভালোমন্দ বোঝার আগেই আরেক ভাসমান মানুষ শ্রমজীবী বাহাদুরের সঙ্গে বিয়ে হয় মুন্নীর। শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাও ঠিকঠাক বলতে পারেননি। এরপরের জীবনযুদ্ধ এভাবেই চলছে। ছোট দুই ভাইও শ্রমজীবীর কাজ করে। বৃদ্ধা মা এখনো বেঁচে আছেন। তবে কেউ কাউকে জোগান দেওয়ার মতো নেই। কারও ভাগ্যে সুখের গন্তব্য মেলেনি।
মুন্নীর ভাষায়-‘ জানি না কীভাবে সামনে দিনগুলা চলমু। কীভাবে পোলাপান মানুষ করমু।’ মুন্নী যেন অভাব-কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। জানালেন, তার কর্ম এলাকায় অসংখ্য খাস জমি ছিল। এখনো আছে। বহু মানুষকে সরকারিভাবে আশ্রয়-আবাসন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২৪টি বছরে এক চিলতে খাস জমি, মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই কিংবা ঠিকানা মেলেনি মুন্নীর।
জোটেনি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কোনো সহায়তা। ঠিকানাহারা এ মানুষটি কী করবেন তাও বলতে পারেননি। এসব কথা জানাতে মুন্নীর চোখ দু’টি ঝাপসা হয়ে যায়। মলিন মুখে, পলকহীন দৃষ্টিতে ক্ষাণিকক্ষণ নীরব থেকে ভারি কন্ঠে বললেন-‘ স্যার আমি আর পারি না।’
হুমায়ুন কবির