ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ মাঘ ১৪৩১

“স্মৃতির পাতায় কলাপাতা” চোখে পরে না কলাপাতায় অতিথি আপ্যায়ন

শফিকুল ইসলাম শামীম, নিজস্ব সংবাদদাতা রাজবাড়ী, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ইং

প্রকাশিত: ১৮:২২, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

“স্মৃতির পাতায় কলাপাতা” চোখে পরে না কলাপাতায় অতিথি আপ্যায়ন

গ্রাম-বাংলার উৎসব মানে কলা পাতা। অতিথি আপ্যায়নে গ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে কলা পাতা সংগ্রহ। ওজয়াজ, ওরস, মিলাত-মাহফিল, জলসা, সুন্নতে খাৎনা, বিয়ে-সাদি অনুষ্টান সব জায়গায় প্রয়োজনীয় ছিল কলাপাতা। বাঙালির ঐতিহ্যের সংস্কৃতি কথাপাতায় অতিথি আপ্যায়ন এখন চোখে পরে না। প্লাটিকের দাপটে হারিয়ে গেছে কলাপাতায় অতিথি আপ্যায়ন। বিজ্ঞানীদের ভাষায় কলাপাতা ঔষধি। এই পাতায় ভাত তরকারি খেলে শরীর দ্রুত হজমের দিকে টেনে নেয়। এছাড়া কলাপাতার অন্যান্য ঔষধি গুণাগুণ তো আছেই।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কলার কদর রয়েছে। দেশে কলার আবাদ ও চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে সারা বছর কলা আবাদ বেড়েছে। বার মাস বাজারে কলা পাওয়া যায়। গ্রাম অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ীর আঙ্গিনা এবং অনেকে কলার প্রজেক্ট করছে। অনেকে অনাবাদি জমিতেও কলার চাষ করছে। কলার অনেক রকম নাম রয়েছে। কিন্ত খাওযার জন্য চাহিদা সবরি ও সাগর কলার কলা বেশি। রান্না করে খাওয়ার জন্য কাচ কলা ও বিচা কলা প্রচুর চাহিদা। কিন্ত এর পরও কলার নানা প্রকার নাম রয়েছে। মদনা, অমৃতসাগর, সাগর দুধসর, দুধ সাগর, চিনি চাম্পা, চাঁপা কবরি, চন্দনকবরি, কাঁঠালি। বীজযুক্ত কলার মধ্যে অন্যতম এঁটে, বেহুলা, মন্দিরা ইত্যাদি।
পূর্বের চেয়ে এখন বেশি বেশি বিভিন্ন প্রকার কলার চাষ হয়। হাতের নাগালে কলাপাতা সংগ্রহ করা যায়। অনেকে বাড়ীর ছাদে টবে কলা গাছ আবাদ করছে। গ্রাম অঞ্চলে ছেয়ে গেছে কলা গাছে। কিন্ত প্লাষ্টিক ও আধুনিকায়নের যুগে কলাপাতার ব্যবহারের চাহিদা নেই বললেই চলে। সিরামিক, কাঁচ ও অস্বাস্থ্যকর প্লাস্টিক দখল করে নিয়েছে কলাপাতার ব্যবহারের চাহিদা। একটি সময় কলা পাতা বাজারে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করতো পণ্য বিক্রি করতে। গুর, লবণ বিক্রি করতে কলাপাতা প্রয়োজনীয় ছিল। ঘোষ দুধ সংগ্রহ করতে গাভি দোয়ানোর পূর্বে বালতিতে কলাপাতা রাখতো।
চাহিদার কারণে ৯০ দশকেও কলাপাতা বাজারে বিক্রি হতো। কিন্ত ২০০০ সালের পর থেকে কমতে শুরু করে কলাপাতা ব্যবহারে। এখন অনুষ্ঠান মানে ডেকেরেটর। প্লাষ্টিকের সামগ্রী ও কমিউনিটি সেন্টার।
শেখ নজরুল ইসলাম বাবু নামের এক ব্যক্তি বলেন, কলাপাতায় খাবারের তুলনা হয় না। অনুষ্ঠান মানে কলাপাতায় খাবার। মসজিদে মিলাদ-মাহফিল, ওরস, ওয়াজ, বিয়ে-সাদি, সুন্নতে খাৎনা, জম্মদিন, আকিকা, গায়ে হলুদ সকল প্রকার অনুষ্ঠানে কলাপাতায় অতিথি আপ্যায়ন। তিনি আরোও বলেন, বাজারে গেলেও কলাপাতায় অনেক প্রকার পণ্য বিক্রি হতো। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য গুর, লবণ, মাছ। শেখ নজরুল ইসলাম বাবু আরোও বলেন, এখন চোখে দেখা মেলে না। পাটি বিছিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন বয়সীরা দাওয়াত খাচ্ছেন। এখন দাওয়াত দেওয়া মানে দামি দামি চেয়ার-টেবিল এবং দামি দামি পেলেট ও গ্লাস।
খোরশেদ নামের এক নতুন প্রজম্ম বলেন, শুনেছি একটি সময় অতিথি আপ্যায়ন করা হতো কলাপাতায়। বাজারে অনেক পণ্য কলাপাতায় বিক্রি হতো। সিননি, তোবারক বিতরন করা হতো। বাবা-দাদার কাছে শুধু শুনেছি। কিন্ত আমাদের প্রজম্মের দেখার ভাগ্য হয়নি। বরং এখন নতুনের ছোঁয়া লেগেছে অতিথি আপ্যায়নে। দামি-দামি ডিনার সেট, চায়ের জন্য দামি কাপ। তবে সামগ্রীর   বাজার দখল করেছে প্লাস্টিকের পণ্য। প্লাস্টিকের পণ্য ক্ষতিকর জেনেও গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত মানুষ ব্যবহার করছে।
শত বছর বয়সী কাশেম আলী মন্ডল স্মৃতি চারন করতে গিয়ে বলেন, গ্রামের মজলিশ, মিলাদ-মাহফিল, বিয়ে-সাদি, সুন্নতে খাৎনা অনুষ্ঠানে বাড়ীর আঙ্গিঁনায় খেঁজুর গাছের পাতা দিয়ে তৈরি পাটি সারিবদ্ধ ভাবে বিছিয়ে দেওয়া হতো। দুই পাশ দিয়ে অতিথিরা সারিবদ্ধ ভাবে পা মিলে বসে পরতো। লোকজন বসার পর সকলের সামনে কলাপাতা দেওয়া হতো। এর পর একজন এসে হাত ধোঁয়ানোর ব্যবস্থা করতো। পরবর্তী জন এেেস প্রত্যেকের সামনে রাখা কলাপাতায় লবণ। এরপর ভাত, পরবর্তীতে মুড়ি ঘোনটো এবং মাংস। ভাত খাওয়ার শেষের দিকে পাতলা ডাউল। পরিশেষে গুও দিয়ে তৈরি পায়েস ও টক দই।
তিনি আরোও বলেন, অতিতে কোন বাড়ীতে আত্মীয়-স্বজনদের বড় সমাবেশে দুপুরের খাবারে কলাপাতায় দেয়া হতো। কলাপাতায় খাবারের স্বাদই আলাদা ছিল। কলাপাতায় ভাত তরকারি তৃপ্তির সঙ্গে চেটেপুটে খাওয়া কলাপাতার আলাদা একটা গন্ধ নাকে লেগে থাকত। কিন্ত কালে কালে  সেই কলাপাতার খাবার আর নেই। এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে শোলার তৈরি ওয়ানটাইম প্লেট।
এসময় ৭৫ বছর বয়সী আক্তার উদ্দিন মিয়া নামের এক বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, কলাপাতায় খাবার এখন চোখে পরে না। মাঠে রাখালেরা একটি সময় কলাপাতায় নিয়মিত খাবার খেত। ছোট বড় অনুষ্ঠানে কলাপাতায় খাবার খেত অতিথিরা। এখন সেই চিরচেনা রুপ ও চিত্র নেই। প্লাস্টির বাজার দখল করে নিয়েছে কলাপাতার বাজার। তিনি আরো দুঃখ করে বলেন, এখন অনুষ্ঠান গুলো প্যাকেজ হয়ে গেছে। কমিউনিটি গুলোতে ছোট ছোট অনুষ্ঠানও পালন করা হচ্ছে। গ্রামের ঐতিহ্য এখন কেউ মনে করে না। সব কিছু যেন বাণ্যিজিক হয়ে গেছে।   
মহিউদ্দিন সরদার নামের এক ব্যক্তি বলেন, অতিথিদের পাশে বসে কলাপাতায় খাওয়ার স্মৃতি আজও মনে পরে। তবে এখন আর কলাপাতায় খাওয়া চোখে পরে না। আমরা এখন অর্থের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছি। কারণ সব কিছু বাজার থেকে সংগ্রহ করতে চাই। তিনি ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, রান্নার ভয়ে অনলাইনে প্যাকেটের খাবার নিয়ে খাচ্ছে অনেকে। তাহলে কলাপাতায় খাবে কখন। কলাপাতায় খাওয়ার সময় ও ইচ্ছা হয়তো এই প্রজম্মের নেই। তবে কলাপাতায় খাবার খাওয়ার মত আনন্দ কোন কিছুতে পাইনি।

মোহাম্মদ আলী

×