১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সমেশপুর গ্রামে সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ছোড়াগুলি কপালে লেগে কমান্ডার হাবিবুর রহমান শাহাদৎ বরণ করেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো হয়নি তার শহীদ ভাতা।
শহীদ হাবিবুর রহমানের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী দুর্গাপুর ইউনিয়নের চরসিংগুলি গ্রামে। শহীদ কোম্পানী কমান্ডার হাবিবুর রহমানের একমাত্র মেয়ে নার্গিস আক্তার মাত্র এক বছর বয়সেই বাবাকে হারান।
তিনি বিভিন্ন অফিস এবং মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের পেছনে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আজ ক্লান্ত। অভিমানে নার্গিস প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন তার বাবার শহীদ ভাতা প্রাপ্তির আশা।
নার্গিস আক্তার বলেন, আমার বাবার আদর যত্ন ভালবাসা কোন কিছুই পাই নাই। বাবার জন্য সব সময় বুকটা খাঁ-খাঁ করে। বাবা দেখতে কেমন ছিলো, তাঁর চেহারা কেমন ছিলো, গায়ের রং কেমন ছিলো, লম্বা কিংবা খাটো ছিল কি না মনে নেই। বাবার কথা শুনলেই খুব কষ্ট লাগে। এসব বলতে বলতে নার্গিস আক্তারের দুচোখ বেয়ে জল চলে আসে। তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
মায়ের মুখে শুনেছি বাবা শহীদ হওয়ার পরে আমাদের পরিবারে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। পরে আমার আরেক চাচার সাথে মায়ের বিয়ে হয়। আমি চাচাদের কাছেই বড় হয়েছি। আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। মা জাহানারা বেগম ৬ বছর আগে মারা গেছেন। আজো জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করে চলেছি। আমার বাবা একজন বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
যখন সবাই এ কথা বলেন তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। তিনি দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন এটা সন্তান হিসেবে আমার এটাই বড় প্রাপ্তি। স্মৃতিস্তম্ভসহ অনেক স্থানে বাবার নাম লেখা দেখে আমি খুব খুশি হই। তখন বাবার আদর না পাওয়ার কষ্ট ক্ষণিকের জন্য ভুলে যাই। মা, চাচা, সহযোদ্ধাদের কাছে বাবার কত না স্মৃতিচারণ শুনেছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা খুব ভাল নেই। আমার ৩ মেয়ে ১ ছেলে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে সালাউদ্দিন গার্মেন্টেসে কাজ করে। স্বামী ইব্রাহীম হোসেন হানিফ সামান্য বেতনে ইমামতি করেন। আমাদের বাড়ি ৩ বার যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে যে বাড়িতে থাকি সেটাও রেওয়াজ বদলের জায়গা। বাবার কবর নদীতে ভেঙে গেছে।
নার্গিস আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেও আমরা ভাতা পাই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার। অনেকস্থানে ঘুরেছি শহীদ ভাতায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য। সরকার কত মানুষকে ঘর দিতেছি, আমাদের একটি পাকা ঘর হলে ভাল হয়। এলেঙ্গা থেকে পটল সড়কের নাম শহীদ হাবিবুর রহমানের নামে করার কথা থাকলেও সেটা আজো হয়নি। সরকারের কাছে শহীদ বাবার যথাযথ সম্মান এবং পরিবারের সুযোগ সুবিধা চাই।
শহীদ হাবিবুর রহমানে ভাই আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, বড়ভাই একজন ভাল মানুষ ও নেতা ছিলেন। ছাত্র অবস্থায়ই বিয়ে করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন কাজে তাকে আমিও সহযোগিতা করেছি। তিনি মারা যাবার পর আমাদের পরিবার একেবারে অসহায় হয়ে ভেঙে পড়ে।
নার্গিসকে আমরা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। তবুও বাবা হারার কষ্টতো থেকেই যায়। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা না পাওয়ায় আমরা ব্যথিত দুঃখিত।
মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার রত্নগর্ভা টাঙ্গাইল। জেলার কালিহাতীতে জন্মেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, গেরিলা যুদ্ধের কিংবদন্তি কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাজাহান সিরাজ, বেসামরিক প্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদ ও নারী সংগঠক হাজেরা সুলতানাসহ অনেক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা।
যারা দেশ মাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে পিছপা হননি, জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। অনেকে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন করতে। শহীদ হাবিবুর রহমান তেমনি একজন অকুতোভয় যোদ্ধার নাম।
হাবিব কোম্পানীর সহযোদ্ধা কালিহাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক কমান্ডার আব্দুল হাই আকন্দ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্বপালন করেছেন যে ক’জন ব্যক্তি তাদের মধ্যে একমাত্র শহীদ কোম্পানী কমান্ডার হলেন হাবিবুর রহমান।
হানাদারদের ছোড়া গুলি তাঁর কপালে লেগে রক্ত ঝরতে ঝরতে আমাদের চোখের সামনেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন। আমরা মইয়ের উপর শুইয়ে রেখে সমেশপুর থেকে পায়ে হেঁটে সিংগুলী আনার পর তাঁকে দাফন করি। এ যুদ্ধে আরো ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সেইসাথে বেশকয়েকজন হানাদার, রাজাকার নিহত ও আহত হয়েছিল।
সেইদিনগুলি আজও চোখে সামনে জল জল করে ভেসে উঠে। শহীদ হাবিবুর রহমানের স্মরণে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সমশেপুরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একটি রাস্তার নামকরণ এবং একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছেন। সহযোদ্ধা ওসমান গনি বলেন, আমি হাবিবুর রহমানের অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাই। শহীদ হওয়ার যুদ্ধে একসাথেই ছিলাম।
তার নামে কালিহাতীর এলেঙ্গা-পটল সড়কের নামকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু সড়ক হয়ে গেছে। আমরা দ্রুত নামকরণের দাবি করছি।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুক্তিযুদ্ধে কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেন, হাবিবুর রহমান একজন নির্ভেজাল সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ হওয়ার খবর শুনে আমি হাবিবুরের বাড়িতে গিয়েছিলাম, পরিবারকে সান্তনা দিয়েছি, কবর জিয়ারত করেছি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা না পাওয়া দু:খজনক।
কুতুবে রব্বানী