ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিজয়ের মাসে লালমোহনের এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা

নিজস্ব সংবাদদাতা,  লালমোহন (ভোলা)

প্রকাশিত: ১৫:৪৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বিজয়ের মাসে লালমোহনের এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা

ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম স্বাধীন-সুন্দর বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য - বীরমুক্তিযোদ্ধা আজাহারুল ইসলাম

ডিসেম্বর মাসটা আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজি বর্ষের শেষ মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতি দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ চুড়ান্ত বিজয় অর্জণ করেছিলো।  এখন চলছে সেই বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এ মাসে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে সূচনা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। তবে এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ঝরেছে বহু প্রাণ আর রক্ত। জীবনের মায়া ত্যাগ করে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৭১ সালের সেই পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির যুদ্ধে লড়াই করেছেন ভোলা জেলার লালমোহন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড পূর্বপাড়া এলাকার নওয়াব আলী হাওলাদার বাড়ির তখনকার যুবক মো. আজাহারুল ইসলাম। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ নিজেই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে শারীরিকভাবে অনেকটা অসুস্থ্য মো. আজাহারুল ইসলাম। দৈনিক জনকন্ঠের এই প্রতিবেদকের কাছে  মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করেন তিনি।


প্রতিবেদককে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আজাহারুল ইসলাম জানান, আমার জন্ম ০১/০৭/১৯৪৯ সালে। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীতে আমার চাকরি হয়। রাজশাহীর সারদার ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রথমে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে এরপর সেখান থেকে টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ লাইনে যোগদান করি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি ও আমার সহকর্মী তোফাজ্জল টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে নওগাঁ জেলা হয়ে ভারতের মধুপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে চলে যাই। তখন সেখানের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল জলিল।  আমি ও তোফাজ্জল পুলিশ বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্য হওয়ায় কমান্ডার আমাদের দুইজনকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করেন।


তিনি জানান, পাঁচ মাস আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করি। ৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মো. নূরুজ্জামনের নেতৃত্বে হিলি এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমাদের তখনকার আক্রমণে পিঁছু হটতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। এরপর নওগাঁ মহাকুমার বদলগাছী থানার পাহাড়পুর হাইস্কুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্প দখল করে আমরা নতুন করে ক্যাম্প করি। তখন আমাদের ওই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মোট ১২৫ জন । এরপর নওগাঁ মহাকুমার পাহাড়পুর থেকে পাকবাহিনী মুক্ত করতে আমরা নানাভাবে যুদ্ধ করি। সেখানের যুদ্ধে আমাদের দুইজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। প্রায় তিন মাস সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমরা পুরো নওগাঁ মহাকুমা থেকে পাকবাহিনীকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হই। এরপর দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীনের পর আমরা অস্ত্র গোলাবারুদ তৎকালীন নওগাঁ মহাকুমা অফিসে জমা দিই। সেখানে আমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য জয় বাংলা সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।


এই মুক্তিযোদ্ধা আরো জানান, পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী থেকে পালিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় আমাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আমার সার্ভিস বুকে পাকিস্তানি পুলিশ ‘গাদ্দার’ লিখে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর আমি টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে পূণরায় যোগদার করি এবং বাংলাদেশ সরকার তখন আমার সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করে নেয়। যা আমার চাকরির খতিয়ান বইতে উল্লেখ আছে। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা বই এর তৃতীয় খন্ডের ৪৬২ পৃষ্ঠায় ক্রমিক নং ১২৮ নাম্বারেও আমার নাম উল্লেখ রয়েছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করি। 


বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আজাহারুল ইসলাম জানান, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম পাকিস্তানিদের বৈষম্য থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে এবং স্বাধীন-সুন্দর বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য। আমরা স্বাধীন হয়েছি সত্যিই, তবে এখনো আমরা পুরোপুরি বৈষম্যমুক্ত হতে পারিনি। অন্যদিকে আমার সহযোদ্ধারা প্রায় সকলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়ে সরকারি সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও আমার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় গেজেটভূক্ত হয়নি। যার জন্য আমি প্রকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরেও কোনো রকম মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা পাইনি। এখন শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ্য। তাই জীবিত থাকতে সরকারি আর কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবো কিনা জানা নেই! তবে বিজয়ের এই মাসে আমার একটাই চাওয়া; আগামীর এই লাল-সবুজের বাংলাদেশ হোক বৈষম্যমুক্ত, এগিয়ে যাক সঠিক পথে, বিশ্বের বুকে সুনামের সঙ্গে মাথা উঁচিয়ে থাকুক আমাদের এই সোনার বাংলা। শত্রমুক্ত এই বাংলাদেশে সবাই ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক এবং সুখে থাকুক। 
 

জাহিদ দুলাল/ শিহাব

×